অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, পৃথিবীর অনেক দেশে একজন নাগরিক একাধিক ভাষায় কথা বলেন। এজন্য ইংরেজি শিখলেই বাংলা ভুলে যেতে হবে, বিষয়টি এমন নয়। শুক্রবার বিকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে পদক হিসেবে একটি স্বর্ণপদক, সম্মাননাপত্র ও প্রাইজ মানি দেওয়া হয়।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের আন্দোলন সূচিত হলেও এর মূল চেতনাটি ছিল স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। এটি ছিল রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা দ্রুতগতিতে নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে চলেছি। এজন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তি প্রধানত দায়ী। প্রযুক্তির প্রাধান্য সঙ্গেই ভাষার প্রাধান্য আসে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নানা দেশের নানা ভাষার কিংবা হাতেগোনা কয়েকটি দেশের কিছু মানুষ নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করেন। নতুন দেশের ভাষা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ২৪ ঘণ্টার ভাষায় পরিণত হয়ে যায়, কিন্তু সেটা ভাষা মাতৃভাষায় পরিণত হয় না। তারা নিজেদের মধ্যে একত্রিত হলেই উৎসাহ সহকারে নিজেদের মূল ভাষায় ফিরে যায়, তাদের মূল ভাষার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে নেয় নিজেদের অজান্তেই।
ড. ইউনূস বলেন, যেসব শহরে তাদের মাতৃভাষাবাসীর সংখ্যা বেশি তাদের শহরের মেয়র, সিটি কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনায়াসে নির্বাচিত হয়। তাদের শহরে তারা নিজেদের মাতৃভাষা নির্দ্বিধায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। তাদের মাতৃভাষায় সরকারি দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করে, তাদের ভাষাভাষী পুলিশ শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে। অথচ শহরের গণ্ডি ছাড়ালেই তারা আবার তাদের নতুন ভাষায় সাবলীলভাবে ফিরে যায়। শহরের নতুন নাগরিকদের নিয়ে পুরোনো নাগরিকদের মনে কোনো ক্ষোভের সৃষ্টি হয় না।
একটি নতুন ভাষা শিখলেই পুরোনো ভাষায় দুর্বল হয়ে পড়বে এ ধারণার কোনো ভিত্তি নেই জানিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর বহু দেশে একই নাগরিক সাবলীলভাবে কয়েকটি ভাষায় কথা বলবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা শৈশব থেকে নানা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্কুলে পড়ার সময় প্রত্যেক ছাত্রকে অন্তত একটি ভিন্ন ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্ররাও আনন্দ সহকারে সেটা করে থাকে। ইংরেজি শিখলেই বাংলা ভুলে যেতে হবে এরকম কোনো চিন্তা তাদের কারো মাথায় আসে না।
‘আমরা দ্রুত গতিতে নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে যাচ্ছি। এর জন্য নিত্যনতুন প্রযুক্তি প্রধানত দায়ী। প্রযুক্তির প্রাধান্যের সঙ্গে আসে ভাষার প্রাধান্য। যে দেশের প্রযুক্তি পৃথিবীতে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে তার সঙ্গে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে প্রযুক্তিদাতা দেশের ভাষা। সারা পৃথিবী এ ভাষা শেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।’
ড. ইউনূস বলেন, স্পুটনিক যখন মহাকাশে উড়ল সারা পৃথিবী রাশিয়ান ভাষা শেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। যে স্কুলে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান ভাষা শেখানো হয় না সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের এবং অভিভাবকদের উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। যেই মাত্র চীন প্রযুক্তিতে এগিয়ে এলো চীনা ভাষা শেখার ধুম লেগে গেল। যে দেশ পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে মানুষ পৃথিবী সে দেশের ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়বে– এটাই নিয়ম। যে দেশের কিছু দেওয়ার নেই সে দেশের ভাষাতেও পৃথিবীর আগ্রহ নেই অথবা থাকলেও নিম্ন পর্যায়ে থাকবে। প্রযুক্তি ছাড়াও যেকোনো দিক থেকে একটি জাতি নেতৃত্ব দিতে পারলে সে দেশের ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বেই— সে ভাষা যত জটিলই হোক না কেন। জাতি এগোলে ভাষা এগোয়। ভাষার সম্মান বাড়ে। নিজ ভাষার নিবেদিত প্রাণ প্রচার কর্মী হওয়া সত্ত্বেও জাতির কাছ থেকে পৃথিবীর ভাণ্ডারে কিছু দেওয়ার না থাকলে ভাষার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
‘ভাষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির সঙ্গে সাহিত্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান— সরাসরি জড়িত। আমরা যখন মাতৃভাষায় কথা বলি তখন যেন মনে রাখি মাতৃভাষা মানুষের প্রাথমিক ভাষা। সেই ভাষা প্রথম শ্রবণে যতই রূঢ় মনে হোক না কেন তা একদিন তার প্রাথমিক স্তর পার হয়ে বহু দেশের বহু মানুষের অত্যন্ত নমস্য ভাষায় পরিণত হতে পারে। যদি সে ভাষা পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় স্ট্র্যাটেজিক বা কৌশলগত ভূমিকা দখল করে নিতে পারে।’
তিনি বলেন, আজ আমরা মাতৃভাষা দিবসে সব মাতৃভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। আবেগের কারণ তো আছেই, মস্ত বড় স্বার্থের কারণও আছে। এখন আমাদের জানা নেই কোন অজ্ঞাত নামহীন মাতৃভাষা পৃথিবী সম্পূর্ণ বদলে দেবে। কোন সম্ভাবনাকে অবজ্ঞা করলে মস্ত বড় ভুল করব। আজ বিশ্ব মাতৃভাষা দিবসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের সার্বিক সাফল্য কামনা করছি।
পড়ুন : অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে আমরা এখন বেশি শক্তিশালী: ড. ইউনূস


