০৮/০৭/২০২৫, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ
25.1 C
Dhaka
০৮/০৭/২০২৫, ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্নের ইতালি নয়, দালালের খপ্পড়ে লাশ হয়ে ফিরলেন নয়ন

স্বপ্ন ছিলো ইতালির মাটিতে পা রাখার। কিন্তু সেই স্বপ্নই কাল হয়ে দাঁড়ালো মাদারীপুরের নয়ন বেপারীর জন্য। প্রবাসে সুখের আশায় পরিবারের সর্বস্ব বিকিয়ে ইতালির পথে পাড়ি জমালেও, শেষমেশ লাশ হয়ে ফিরলেন দেশের মাটিতে। দালালচক্রের অমানবিক নির্যাতনে প্রাণ হারিয়েছেন এই যুবক।

মাদারীপুর সদর উপজেলার কেন্দুয়া ইউনিয়নের নয়াকান্দি গাজিরচর গ্রামের যুবক নয়ন বেপারী। আপন মামা উজ্জ্বল সরদারের প্রলোভনে পড়ে স্বপ্নের দেশ ইতালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরিবারের নিষেধ সত্ত্বেও বিদেশ পাড়ির স্বপ্ন ছাড়তে পারেনি নয়ন। দালালের সাথে ইতালি পৌঁছানোর চুক্তি হয় ১৪ লাখ টাকায়।

কিন্তু সরাসরি ইতালি না পাঠিয়ে, দালাল উজ্জ্বল প্রথমে নয়নকে শ্রীলঙ্কা এবং পরে লিবিয়ার ব্যানগাজিতে পাঠায়। সেখানেই একটি মাফিয়া চক্রের বন্দিশালায় আটক হয়ে পড়েন নয়ন। শুরু হয় মর্মানি্তক অত্যাচার।

নয়নের চাচা সম্রাট ব্যাপারী বলেন, ”নয়নের মামাই নয়নকে চোরাই ও অবৈধ পথে ইতালি পাঠানোর মূল হোতা। তিনিই নয়নকে ইতালি যাবার প্রলোভন দেখিয়ে পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়েও রাজি করান নয়নকে।

এরপর অবৈধ পথে ইতালির জায়গায় তাকে পাঠায় শ্রীলঙ্কায়। এরপর শ্রীলঙ্কা থেকে নিয়ে যাওয়া হয় লিবিয়ায়। সেখানে চালানো হয় অমানবিক নির্যাতন। তাকে অত্যাচারের ভিডিও দেখিয়ে পরিবার থেকে আত্মসাৎ করে ৭১ লাখ টাকা।”

পরিবারকে ভিডিও কলে রেখেই নয়নের উপর চলে অমানবিক নির্যাতন। প্রথমে ২৩ লাখ টাকা দাবি করে দালালচক্র। ছেলের মুক্তির আশায় জমিজমা বিক্রি করে, ঋণ করে, সর্বস্ব দিয়ে টাকা পাঠান পরিবার। কিন্তু তাতেও থামে না নির্যাতন।

নয়নের ফুপু শারমিন আক্তার জানান, ”ভাইয়ের ছেলে নয়ন আটক থাকা অবস্থায় ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলতো আমাকে একবেলাও খেতে দিচ্ছেনা। আমার অনেক কষ্ট হয়। আপনারা টাকা দিলে আমাকে খেতে দিবে।”

তিনি আরো বলেন, “নয়ন বলেছিলো, ওরা হুমকি দিয়েছে টাকা না দিলে আমাকে গেমঘরে পাঠাবে। নয়নের সাথের সবাইকে গেমঘরে পাঠিয়েছে। টাকা দিলে দ্রুতই তাকে মুক্ত করে দিবে।”

পরের মাসেই দালালদের থেকে ফের দাবি আসে ১৩ লাখ টাকা, তারপর ১৫ লাখ, আর সর্বশেষ ৬ লাখ টাকা। মোট ৭১ লাখ টাকা আদায় করেও মুক্তি মিলেনি নয়নের। টাকা দিতে দিতে নিরুপায় হয়ে পড়ে পরিবার। সঞ্চয়, সম্পত্তি সব বিক্রি করে এক সময় ফুরিয়ে আসে পরিবারের অর্থ। এরপর টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে আবারও চলে নির্যাতন।

অবশেষে গত বুধবার খবর আসে, লিবিয়ায় মারা গেছেন নয়ন। পরিবারের দাবি, টাকা আদায়ের জন্যই দালালচক্র তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে।

নয়নের বাবা আশরাফ চৌধুরী বলেন, “জায়গা, জমি বিক্রি করে ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। এরপর ছেলেকে নির্যাতনের ভিডিও দেখে ঋণ নিয়ে দালালদের টাকা দিয়েছি। ঋণের বোঝা এখন এতো বেশি যে আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটতে পারিনা। পাওনাদারদের নজর এড়াতে জঙ্গল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কোথাও যেতে হয় আমাকে।”

তিনি বলেন, ”আশা ছিলো ছেলে মুক্ত হয়ে ফিরলে হয়তো বিদেশে কাজ নিয়ে অর্থ উপার্জন করে আমাদের টাকা পাঠাবে। সেই টাকা থেকেই আমি ঋণ শোধ করবো। কিন্তু এখন আমার ছেলে আর ফিরলোনা।”

নয়নের চাচা সম্রাট ব্যাপারী বলেন, ”এখন এমন অবস্থা তার পরিবারের যে আবাসিক ভিটা টুকু বিক্রি করলেও এই দেনা শোধ সম্ভব নয় তার পরিবারের পক্ষে।”

তিনি আরো বলেন, ”এখন কেবল ছেলের কাফনের কাপড়টুকুই আছে আমাদের কাছে। এর থেকে বেশি আর কোনো টাকাই নেই আর আমার।”

এদিকে প্রশাসন বলছে, তদন্ত করে দায়ীদের আইনের আওতায় আনা হবে। মাদারীপুর সদরের নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াহিদা শাবাব জানান, “মন্ত্রণালয় থেকে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মিলে দেশের বিভিন্ন জেলায় সক্রিয় দালালচক্র সম্পর্কে অবগত। ইতোমধ্যে একাধিক তালিকা তৈরি করেছে তারা।”

ইতালি যাওয়ার স্বপ্নে নয়নের পরিবার হারিয়েছে তাদের প্রিয় সন্তান, সর্বস্ব হারিয়ে এখন তারা নিঃস্ব। নয়নের মতো আর যেন কাউকে এমন মর্মান্তিক পরিণতি ভোগ করতে না হয়— এমনটাই চান এলাকাবাসী।

স্বপ্নের দেশ নয়, দালালের ফাঁদে পা দিয়ে মৃত্যুর দুয়ারে নয়ন। সরকারের প্রতি আহ্বান, যেন এমন কোনো পরিবারকে আর চোখের জলে সন্তানের লাশ গ্রহণ করতে না হয়।

এনএ/

দেখুন: প্রেমিকাকে ১১শ কোটির সম্পত্তি দিয়েছেন ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ প্রতিবেদন