ছাত্র-জনতার আন্দোলনের তোপের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রশাসন ছাড়াই একটি রাষ্ট্রের বড় বড় সব দায়িত্ব তুলে নেয় নিজেদের ছোট্ট-চওড়া কাঁধে। আর সেই শিক্ষার্থীদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। বন্যার মতো দুর্যোগও মোকাবিলা করে একতাবদ্ধ হয়ে।
বাঙ্গালী জাতি জিততে জানে। অনেকগুলো বছর পর সেই ঐক্যবদ্ধ শক্তি দিয়েই ওরা রুখে দিয়েছে গত ১৫ বছরের দমন-পীড়ন। হটিয়ে দিয়েছে দেশের অপরাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা। জেনারেশন-জেডের সংঘবদ্ধ হওয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের পাশে অনড় ছিলেন দেশের প্রতিটি স্তরের আপামর সাধারণ জনতা।
জুলাই মাসের কোটা সংস্কার আন্দোলন এর শুরুটা চার দফা দাবি নিয়ে হলেও পরবর্তীতে দাবি না মেনে বিভিন্ন অপশক্তির মাধ্যমে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা করলে শিক্ষার্থীরা দাবি করেন নয় দফার। এরপর তা রুপ নেয় সরকার পতনের এক দফা দাবিতে। বিভিন্ন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিল পুরো দেশ। মাঝের সময়টিতেও ছিল রাজপথ রঞ্জিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচী থেকে শুরু করে কম্পলিট শাটডাউন, অসহযোগ কর্মসূচী, রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোস, মার্চ ফর জাস্টিস এবং লং মার্চ টু ঢাকার মতো কর্মসূচীও।
শিক্ষার্থীদের সাথে এই আন্দোলনে ধীরে ধীরে যখন সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক, চিকিতসক, শিক্ষক, আইনজীবী থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের। আর তখনই নানান বাহানায় বন্ধ করে দেয়া হয় ইন্টারনেট সেবা। দেশজুড়ে বাড়তে থাকে না ফেরার দেশে যাত্রা করা মানুষের সংখ্যা। ক্ষোভে, ক্রোধে ফেটে পরেন সাধারণ জনগণ।
চোখের সামনে সন্তান সমতুল্য আবু সাইদের মতো শিক্ষার্থীদের দিকে বন্দুক তাক করতে দেখে ঘরে থাকতে পারেননি বিবেকজাগ্রত নাগরিকেরা। লং মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের ডাকে শহীদ মিনারে এসে জড়ো হয়েছিলেন অভিভাবক থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। পাখির চোখে দেখা সেই মানুষের সংখ্যা পরিমাপ করা যায় নি তবে সেদিন বাংলাদেশের মানুষের ঐক্যতা দেখে অবাক বিস্ময়ে আরো একবার তাকিয়ে ছিল পুরো বিশ্ব।
৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজপথে শুরু হয় সর্বস্তরের মানুষের বিজয় উল্লাস। গত কয়েকদিনের গুলির শব্দে আতঙ্কিত জনপদ দেখে যেন মনে হয় এ এক বহুল কাঙ্খিত উৎসব। বাংলার আকাশে বাতাসে ভাসতে থাকে সেদিন ছাত্র-জনতার জয়ধ্বনি।
গণঅভ্যুত্থানের পর সামনে আসে এক নতুন বাংলাদেশ। গঠন করা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। উপদেষ্টা মন্ডলীর সাথে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত লাগান দেশের শিক্ষার্থীরা। ছাত্র-জনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রবল ইচ্ছেশক্তি ধরা পরে তাদের কর্মকাণ্ডে। প্রশাসন ছাড়া একটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব তুলে নেন ছোট্ট-চওড়া কাঁধে। কখনো ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করা, কখনো বাজার মনিটরিং আবার কখনো রং তুলি দিয়ে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির আয়োজনে নতুন এক সাম্যের বাংলাদেশের চিত্র।
দেশের এমনই টালমাটাল অবস্থায় নেমে আসে বন্যার মতো ভয়াবহ দুর্যোগ। গত ৩৪ বছরের মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলের মানুষ সাক্ষী হন সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রতিক এই বন্যার। তবে সেই বন্যা দুর্গতদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিল সারাদেশের মানুষ।
টিএসসি তে গণত্রাণ কর্মসূচি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের সহায়তা, প্রধান উপদেষ্টার ত্রাণ তহবিলে সহায়তার বাইরেও ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বন্যা দুর্গতদের হাতে হাতে ত্রাণ তুলে দেয়ার সেই অভূতপূর্ব ঐক্যতার দৃশ্যও হৃদয় নিংড়েছে সকলের।