ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস মারা গেছেন। তিনি শুধু ধর্মগুরুই ছিলেন না। মানবতার পক্ষে কাজ করেছেন বিশ্বজুড়ে। তার পুরো নাম জর্জ মারিও বেরগোগলিও। ২০১৩ সাল থেকে তিনি ক্যাথলিক গির্জার ২৬৬তম পোপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাশাপাশি তিনি পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাষ্ট্র ভ্যাটিকান সিটির রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন। আর্জেন্টিনা তথা সমগ্র আমেরিকা থেকে নির্বাচিত প্রথম পোপ ছিলেন তিনি।
১৯৩৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন জর্জ মারিও বেরগোগলিও (পোপ ফ্রান্সিস)। তার বাবার নাম হোসে মারিও বেরগোগলিও (১৯০৮-১৯৫৯)। মায়ের নাম রেজিনা মারিয়া সিভোরি (১৯১১-১৯৮১)। তার পূর্ব বংশধর ১৯২৯ সালে ইতালির পিয়েমন্ত থেকে আর্জেন্টিনায় চলে যায়। তার মায়ের পূর্বপুরুষ উত্তর ইতালির অধিবাসী ছিলেন।

পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ছিলেন সবার বড় ফ্রান্সিস। তিনি উইলফ্রেড ব্যারন দ্য লস সানটোস অ্যাঞ্জেলেস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করেন। ফ্রান্সিস ইসকুয়েলা ট্যাকনিকা নাসিওনাল দ্য এডুকেসিয়ন হিপোলিটো হিগুয়েন থেকে কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান বিষয়ে হাইস্কুল ডিপ্লোমা লাভ করেন। এর পর তিনি কয়েক বছর একটি ল্যাবরেটরির খাদ্য বিভাগে কেমিক্যাল টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন। সঙ্গীত, ফুটবল এবং টানগো খেলা পছন্দ করতেন ফ্রান্সিস। দরিদ্র প্রেম ও ধর্মাদর্শ পরিবার থেকেই লাভ করেন তিনি।
১৯৫৫ সালে ১৯ বছর বয়সে যাজক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সেমিনারিতে প্রবেশ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি যিশু সংঘের (জেজুইট) নব্যা লয়ে প্রবেশ করেন। ১৯৬০ সালে যিশু সংঘে দরিদ্রতা, কৌমার্য ও বাধ্যতার সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। একই বছর তিনি আর্জেন্টিনার সান মিগেলে অবস্থিত কলেজিও ম্যাক্সিমো দ্য সান হোসে কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালে দর্শনশাস্ত্রে লাইসেনসিয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪-৬৬ সাল পর্যন্ত একটি কলেজে সাহিত্য ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ঐশীতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৭ সালে সান হোসে কলেজ থেকে ঐশী তত্ত্বে ডিগ্রি লাভ করেন।

মাত্র ৩৩ বছর বয়সে (১৯৬৯ সালে) আর্চবিশপ জোস ক্যাস্টিলিয়ানো দ্বারা যাজক হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৭০ সালে তিনি যিশু সংঘে চিরব্রত (পোপের প্রতি বাধ্যতা) গ্রহণ করেন। এর কয়েক মাস পরই ১৯৭৩ সালের ৩১ জুলাই তিনি যিশু সংঘের আর্জেন্টিনা প্রদেশের প্রদেশপাল (প্রভিন্সিয়াল সুপিরিয়র) নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে সান মিগেলে অবস্থিত দর্শনশাস্ত্র ও ঐশী তত্ত্বের সেমিনারির পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত পরিচালক ও অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬ সালে তিনি জার্মানির ফ্রাংকফুর্টে যান এবং ঐশী তত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। যাজক হওয়ার পর থেকেই তিনি অক্লান্তভাবে দরিদ্র মানুষের সেবা করেন।
১৯৯২ সালে তিনি আউকা ধর্মপ্রদেশের টিটুলার বিশপ হিসেবে অভিষিক্ত হন। পরে বুয়েনস এইরেস ধর্মপ্রদেশের অক্সিলারি বিশপ হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৭ সালে তিনি বুয়েনস এই রেস ধর্মপ্রদেশের কো-অর্ডিনেটর আর্চবিশপ হিসেবে মনোনীত হন এবং আর্চবিশপ কার্ডিনাল আন্তনিও কোয়ারোসিনোর মৃত্যুর পর ১৯৯৮ সালে ওই ধর্মপ্রদেশের আর্চবিশপ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর্চবিশপ হয়ে তিনি প্রশাসনিক ব্যবস্থা নতুনভাবে ঢেলে সাজান।
তিনি পুণ্য বৃহস্পতিবারের পা ধোয়ার অনুষ্ঠানটি জেলখানায়, হাসপাতালে, বয়স্ক হোমে, বস্তিতে, বাসায় (রোগী) ও কারাবন্দিদের জন্য পালন করার প্রচলন শুরু করেন। আর্চবিশপ হওয়ার তিন বছর পরই ২০০১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পোপ দ্বিতীয় জন পল তাকে আর্জেন্টিনার কার্ডিনাল নিযুক্ত করেন।
তিনি ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর আর্জেন্টিনার বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিশপ সম্মিলনীর প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান ও মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষভাবে তিনি পন্টিফিক্যাল ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয় অব আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
পোপ ষোড়শ বেনেডিক্ট মানসিক ও বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। এর পর নতুন পোপ পেতে শুরু হয় নির্বাচন। ১২ ও ১৩ মার্চ দুই দিন লাগে পোপ নির্বাচনে। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স চার্চে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দিন বিকেলে নির্বাচনে বসেন ৪৮ দেশের ১১৫ ধর্মযাজক। কিন্তু পরপর চারবার ভোট দিয়েও তারা পোপ নির্বাচনে ব্যর্থ হন। ফলে ব্যালট পুড়িয়ে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনিতে কালো ধোঁয়া তৈরি করা হয় যেন অপেক্ষমাণ ধার্মিকরা বুঝতে পারে, পোপ নির্বাচন তখনও সম্ভব হয়নি। অবশেষে ১৩ মার্চ বিকেলে চিমনির চূড়ায় দেখা গেল সাদা ধোঁয়া। সেই সাদা ধোঁয়া দেখে সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে অপেক্ষমাণ জনতা উল্লসিত হয়ে ওঠেন। সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ঘণ্টাটিও বেজে ওঠে। এর এক ঘণ্টা পর নতুন পোপ হিসেবে জর্জ মারিও বেরগোগলিওর (ফ্রান্সিস) নাম ঘোষণা করা হয়।
ক্যাথলিক চার্চের সংস্কারের প্রতীক হয়ে থাকা সেন্ট ফ্রান্সিস অব আসিসির আদর্শ স্মরণে ‘ফ্রান্সিস’ নামটি ধারণ করেছেন। তিনিই প্রথম, যিনি ফ্রান্সিস নাম গ্রহণ করেন অর্থাৎ তিনি প্রথম পোপ ফ্রান্সিস। পোপ নির্বাচিত হওয়ার পর প্রাথমিক যে আনুষ্ঠানিকতাগুলো ছিল, সেখানে তিনি সেই দরিদ্রতাকেই প্রাধান্য দেন।
টাইম ম্যাগাজিন ২০১৩ সালে তাকে বছরের সেরা ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দেয়। দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত ও প্রান্তিক জনগণের প্রতি তার দরদ, সহানুভূতি ও ভালোবাসা এবং তাদের পক্ষে কথা ও কাজ করার জন্য তাকে এই সম্মানজনক খ্যাতি দেয়া হয়। সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ভ্যানেটি ফেয়ারের ২০১৩ সালের ১৭ জুলাইয়ের ২৮তম সংখ্যার প্রচ্ছদে পোপ ফ্রান্সিসের ছবি ছাপানো হয়। প্রচ্ছদের শিরোনাম দেয়া হয় ‘সাহসী পোপ ফ্রান্সিস’। ভ্যানেটি ফেয়ার আরও লিখেছিল, পোপ ফ্রান্সিসকে বিশ্বনেতৃত্বের জন্য আগাম ‘বর্ষসেরা’ ঘোষণা করা হলো।
রক রোনাল্ড রোজারিও (বাংলাদেশ ব্যুরোপ্রধান, ইউনিয়ন অব ক্যাথলিক এশিয়ান নিউজে) লেখেন, বিভিন্ন সময়ে পোপ ইসলাম ধর্মের প্রতি সহনশীল মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ ও সহিংসতার সঙ্গে ইসলামকে মিলিয়ে ফেলার ভ্রান্ত প্রবণতাকে পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং পশ্চিমা বিশ্বে ক্রমবর্ধমান ‘ইসলামভীতির’ (Islamophobia) সমালোচনা করেছেন। বরং তিনি মুসলিমদের সমর্থনে পশ্চিমা বিশ্বেও নৈতিক অবক্ষয়ের সমালোচনা করেন।
স্থানীয় সময় সোমবার (২১ এপ্রিল) সকাল ৭টা ৩৫ মিনিটে মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৮ বছর।