রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের স্বচ্ছ জলে ফুল ভাসিয়ে বাংলা পুরাতন বছরকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। শনিবার (১২ এপ্রিল) ভোরে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। ফুল বিঝুতে রাঙামাটিতে পাহাড়ি নারীরা বাহারি রঙের ঐতিহ্যবাহী পিনন-হাদি আর ছেলেরা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে কাপ্তাই হ্রদে ফুল ভাসান।

এদিন সকাল সাড়ে ৬টার পর আনুষ্ঠানিকভাবে রাঙামাটির রাজবন বিহারে পূর্বঘাটে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় ঊষাতন তালুকদার, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি প্রকৃতি রঞ্জন চাকমাসহ বিভিন্ন সংগঠনের সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও পাহাড়ি নারী-পুরুষেরা ফুল ভাসিয়েছেন।

এছাড়া কাপ্তাই জেলা শহরের গর্জনতলী, কেরানী পাহাড়, আসামবস্তিসহ জেলার দশ উপজেলায় চাকমারা ছাড়াও ত্রিপুরা এবং তঞ্চঙ্গ্যা জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাও নদীতে-ঝিরির পানিতে ফুল ভাসিয়েছেন। এসময় সকলেই পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ও গ্লানি দূর করে নতুন বছর যাতে সুখ শান্তিতে কাটানো যায়; সে উদ্দেশ্যে পানিতে ফুল ভাসান। পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে গিয়ে নতুন বছর বয়ে আনবে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি; এমনটাই প্রত্যাশা করছেন পাহাড়িরা।

রাঙামাটির রাজবন বিহারের পূর্বঘাটে ফুল এসে মার্সি চাকমা নামে এক নারী বলেন, ‘বিঝু আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের প্রধান ঐতিহ্যবাহী উৎসব। আজকে হচ্ছে (১২ এপ্রিল) বিজুর প্রথম দিন ফুল বিঝু। ফুল বিঝুতে আমরা পানিতে ফুল ভাসিয়ে মা গঙ্গা দেবীর কাছে আমরা সকলে প্রার্থনা করি, পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট ও গ্লানি দূর করে নতুন বছর যাতে সুখ শান্তিতে কাটাতে পারি।’
পারমী চাকমা বলেন, ‘আমি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফুল নিয়ে আমাদের চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পিনন-হাদি পরে পানিতে ফুল ভাসাতে এসেছি। আমি ফুল ভাসিয়ে গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করেছি নতুন বছরে আমরা যাতে সবাই সুখে শান্তিতে ভালো থাকতে পারি। পাহাড়ে যেন আর হানাহানি না ঘটে।’

কাপ্তাই চাকমা কালচারাল কাউন্সিল বাংলাদেশের (সিসিসিবি) প্রতিষ্ঠাতা লিটন চাকমা বলেন,
‘আমরা ভোরে বিভিন্ন বাড়ি থেকে ফুল সংগ্রহ করে নদী বা ছড়াতে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করে থাকি। এভাবে আমরা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে থাকি।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় ঊষাতন তালুকদার বলেন, ‘বিঝু মানে চেতনা, বিঝু মানে আনন্দ-উচ্ছ্বাস। পুরাতন বছরের গ্লানি, দুঃখ, কষ্টকে ফেলে নতুন বছরের আশা রাখব, এই পার্বত্য অঞ্চেেলর মানুষ যেন নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারি। সকলে মিলে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারি।’
রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মোহাম্মদ হাবিব উল্লাহ বলেন, ‘এ সকল উৎসবকে কেন্দ্র করে রাঙামাটি পুরো শহর এক উৎসবে পরিণত হয়েছে। আমরা আশা করছি এ সকল উৎসব উদযাপনের মাধ্যমে আমরা আগামী দিনের সৌহার্দ্য সম্প্রতিকে আরও সুদৃঢ় করবে।’

পার্বত্য জেলা রাঙামাটির ওপর দিয়ে বয়ে চলা চেঙ্গী, মাইনী, কাচালং, রীংক্ষ্যং, কর্ণফুলীসহ পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝিরি-ছড়ায় ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে রাঙামাটিতে উদযাপিত হচ্ছে বর্ষবরণ। উৎসবের প্রথম দিনে বন থেকে ফুল আর নিমপাতা সংগ্রহ করে এবং পবিত্র এই ফুল ভাসিয়ে দেয় পানিতে; তাই একে বলা হয় ফুল বিঝু। পানিতে ফুল ভাসিয়ে বিশ্ব শান্তির মঙ্গল কামনায় গঙ্গা দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীরা যুগ যুগ ধরে এই উৎসব পালন করে আসছে।
আগামীকাল (রোববার) বিঝু উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু। এদিনে বাড়িতে বাড়িতে রান্না করা হবে পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী খাবার ‘পাজন’। পাজনসহ বিভিন্ন ধরণের খাবার দিয়ে অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। এর পরদিন বা উৎসবের তৃতীয় দিন হচ্ছে গজ্যাপজ্যা বিজু বা নববর্ষ উৎসব। এদিনে বিশ্ব শান্তির কামনায় বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে প্রার্থনা করেন পাহাড়িরা।
উল্লেখ্য যে, আগামী ১৬ এপ্রিল রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙালহালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মারমা জাতিগোষ্ঠীর সাংগ্রাই জলোৎসব বা জলকেলির মধ্য দিয়ে সাঙ্গ হবে পাহাড়ের বর্ষবিদায় ও বরণের বর্ণাঢ্য আয়োজন।
পড়ুন: ছেড়ে দেয়া হলো কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি গেট
দেখুন: ৬ ঘণ্টা পর বন্ধ করে দেয়া হলো কাপ্তাই বাঁধের কপাট
ইম/