একটা সময় ছিল বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু গত এক দশকে ফুটবল তেমন একটা দর্শক টানতে পারেনি। সম্প্রতি ফুটবল যেন আবারও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে আসছে। বেশ কয়েকজন নতুন খেলোয়াড় ফুটবলে যুক্ত হওয়ায় ফুটবলের উন্মাদনা দেখা যাচ্ছে। আর ক্রিকেট যেন দিনকে দিন চুপসে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে।
বাঙালির ফুটবল আবেগ তো চিরাচরিত। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় বিশ্বকাপ ফুটবল আসলেই। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামেও উড়তে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের পতাকা। প্রিয় দলের জার্সি পরে সমর্থন জানানো, প্রিয় খেলোয়াড়ের নামে ব্যানার-পোস্টার…এসব দৃশ্য প্রতি বিশ্বকাপেই দেখা যায়। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের ভক্ত বাংলাদেশে বেশি। প্রিয় দুই দলের পতাকায় ছেয়ে যায় বাংলাদেশের আকাশ।

এক সময় দেশের ঘরোয়া ফুটবল ছিল মানুষের বিনোদনের অন্যতম উৎস। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচ ঘিরে তর্ক-বিতর্ক জমে উঠত টং দোকান থেকে শুরু করে বাসার ড্রয়িং রুম পর্যন্ত। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে দেশের ফুটবলের সেই জৌলুস ফিকে হয়ে যায়। গ্যালারি হয়ে পড়ে ফাঁকা, দর্শক মুখ ফিরিয়ে নেয় ঘরোয়া ফুটবল থেকে, আগ্রহ বেড়ে যায় বিদেশি লিগের প্রতি। ধীরগতির খেলার কারণে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে ঘরোয়া ফুটবল। অন্যদিকে কর্পোরেট পৃষ্ঠপোষকতায় রঙিন হয়ে ওঠে ক্রিকেট। আন্তর্জাতিক সাফল্য, সুদর্শন তারকা ক্রিকেটারদের আবির্ভাব এবং ধারাবাহিক পারফরম্যান্স ক্রিকেটকে এনে দেয় বিশেষ স্থান।
অন্যদিকে দেশের ফুটবলে দেখা দিয়েছে নতুন প্রাণ। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে খেলা হামজা চৌধুরী, ইতালির লিগে ফাহামেদুল ইসলাম, কানাডায় খেলা সামিত সোমদের আগমনে ফুটবলের গ্যালারি আবারও দর্শকে ভরে উঠছে। টিকিটের জন্য মানুষের হাহাকার, বাফুফের সামনে সমর্থকদের অবস্থান কর্মসূচি…এসব দৃশ্য এখন আবার দেখা যাচ্ছে।

তবে ক্রিকেটকেও এই অবস্থানে আসতে সময় লেগেছে। ১৯৯৭ সালের ৪ এপ্রিল; কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফিতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় সেই পথচলার সূচনা করে। তার অপরাজেয় ৬৮ রানের ইনিংস বদলে দিয়েছিল দেশের ক্রিকেট মানচিত্র।
এরপর থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে শক্ত অবস্থান তৈরি করে বাংলাদেশ। সাকিব, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদ…তারা হয়ে ওঠেন দেশের ঘরের সন্তান। তবে সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেটও এখন চ্যালেঞ্জের মুখে। তারকাসংকট, ধারাবাহিকতার অভাব এবং মাঠের বাইরের বিতর্কে আলোচনার বদলে এখন ক্রিকেটে সমালোচনাই বেশি।

ফুটবলের আবেগ অন্য সব খেলার চেয়ে আলাদা। আবাহনী-মোহামেডানের অনুশীলনে যে দর্শক হতো, অনেক সময় তা ক্রিকেট ম্যাচকেও ছাড়িয়ে যেত। হামজাদের আগমনে আবারও ফুটবলে সেই পুরোনো দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যা সত্যিই আনন্দের। এমনকি ফুটবল ঘিরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে এদেশের মানুষ।
তবে ক্রিকেট হোক আর ফুটবল, দুটোই দেশের পতাকা বহন করে। এখন ক্রিকেট একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সময় লাগবে নতুন তারকা তৈরি হতে। আশা করি ফুটবলের এই জাগরণও ধরে রাখা যাবে। সবকিছুর জন্যই থাকতে হবে সঠিক পরিকল্পনা। সাধারণ মানুষ চায় দেশের সফলতা। প্রতিটি জয়ই পারে দর্শকদের আনন্দ দিতে। আর বাংলাদেশ যত জিতবে ততই জনপ্রিয়তা বাড়বে। সেটা হোক ক্রিকেট কিংবা ফুটবল। আর ব্যর্থতার পাল্লা ভারি হলে জনপ্রিয়তাও কমতে থাকবে।
সবশেষ ২০০৩ সালেও ফুটবলে এমন জোয়ার দেখা গিয়েছিল, যখন সাফ শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু সাংগঠনিক ব্যর্থতা, অব্যবস্থা আর অবহেলার কারণে সেই জনপ্রিয়তা টেকেনি। প্রবাসী ফুটবলাররা এবার শক্তি বাড়ালেও ভবিষ্যতের জন্য স্থানীয় খেলোয়াড়দের উন্নয়ন জরুরি। আর সেদিকেই নজর দিবে বাফুফে। এমন প্রত্যাশা ফুটবলপ্রেমিদের।
ক্রিকেট বা ফুটবলে যখন সফলতা আসে, তখনই তারা আগ্রহী হয়। তবে লয়্যাল ফ্যানরা সবসময় খেলাটার সাথেই থাকে। এটা টিকিয়ে রাখতে হলে চাই ধারাবাহিক পারফরম্যান্স এবং মাঠের প্রতি মনোযোগ।

এদিকে ক্রিকেটের পতন শুরু হয় মাঠের বাইরের কার্যক্রম বেশি আলোচিত হলে। ফুটবলেও যদি বাই প্রোডাক্টগুলো প্রাধান্য পায়, তাহলে উন্নয়ন থমকে যাবে। আরব আমিরাতের মতো দলের কাছে হার, পাকিস্তান সিরিজে ভরাডুবিও ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা কমার কারণ। এছাড়া ক্রিকেট বোর্ডে অস্থিরতা। বোর্ড সভাপতি ফারুক আহমেদ মাত্র ৯ মাস টিকতে পারলেন। অনেকটা বাধ্য করা হয়েছে তাকে সরে যেতে। নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল। তার নেতৃত্বে ক্রিকেট আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা দেখছে ক্রিকেটপ্রেমিরা।
অন্যদিকে ফুটবলে নতুন কমিটি ও বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্বে বর্তমানে মাঠের খেলা গুরুত্ব পাচ্ছে, যা ইতিবাচক। তবে এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। ফুটবল ফিরে পাচ্ছে তার হারানো আবেগ, ঘরের আনন্দের উৎস হয়ে উঠছে আবারও। ক্রিকেট তার জায়গায় থাকবে, তবে ফুটবলের এই জাগরণ যেন ক্ষণিকের না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠের খেলাই আসল। এটাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠুক নতুন দিনের বাংলাদেশের ফুটবল।