জহির রায়হানের সিনেমাটি শুরু হয় শহরের রাস্তার পানিতে আলো পড়ার এক দৃশ্য দিয়ে। গাড়ি চলার রাস্তায় জমে আছে পানি। সেখানে লাইটের আলো পড়ে সেগুলো যেন তাদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে। যেন ঘুরছে মানব জীবনের চাকা। আর অস্তিত্ব হারাচ্ছে জীবনের সব আলো।
সিনেমার নাম ‘কখনো আসেনি’। প্রখ্যাত পরিচালক জহির রায়হানের এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর। এটি তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা। এর আগে কয়েকটি সিনেমায় সহকারী পরিচালকের কাজ করেছেন তিনি। সেগুলোর মধ্যে ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ অন্যতম।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নতুন ধারা নিয়ে আসতে ‘কখনো আসেনি’ নির্মাণ করেন জহির রায়হান। এই চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হয়-
দেশের জনগণ বিশ বছর পরে যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিল। বিশ বছর আগেই দেশের তরুণরা সে ছবি তাদের উপহার দিল।
এক অনবদ্য নাম জহির রায়হান
রূপকভাবে সমাজের বাস্তবতাকে উপস্থাপন করতে এক অনবদ্য নাম জহির রায়হান। পরবর্তীতে তার সেরা কাজ ‘জীবন থেকে নেয়া’ সিনেমায় এমন চিত্র দেখা যায় চমৎকাররূপে। এই চলচ্চিত্রের সাফল্য নিয়ে জহির রায়হান এর অনেক আশা ছিল। কিন্তু এটি বাণিজ্যিকভাবে তেমন সফল হয়নি। তবে, ব্যতিক্রমধর্মী কাহিনী, সাবলীল ভাষা, উপস্থাপনা ও নির্মাণশৈলীর জন্য এই ছবি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
‘কখনো আসেনি’ চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র মরিয়ম। এ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুমিতা দেবী। এই মরিয়মকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্রটির কাহিনী। আরেকটি চরিত্র সুলতান। তিনি একজন সৌখিন সংগ্রাহক ও শিল্প সমঝদার। তিনি শিল্পের জন্য যেকোন কিছু করতে পারেন। খলনায়ক হিসেবে এই চরিত্রে দারুণ অভিনয় করেছেন সঞ্জীব দত্ত। তার হাঁটাচলা আর কথা বলার ধরনে তাকে একজন অপ্রকৃতস্থ মানুষ মনে হয়। চিত্রশিল্পী শওকতের ভূমিকায় ছিলেন খান আতাউর রহমান। তার দুই ছোটবোনের একজন ছিলেন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় নায়িকা শবনম, আরেক চরিত্রে কণা।
এই সিনেমায় রয়েছে কয়েকটি দ্বন্দ্বের উপস্থাপন। মূর্ত আর বিমূর্তের দ্বন্দ্ব। শিল্পপ্রেমের সাথে একজন শিল্পির সংগ্রামের দ্বন্দ্ব। বাস্তব জীবনের সাথে কল্পনার এক ভয়াবহ দ্বন্দ্ব। যে দ্বন্দ্ব অনন্তকাল ধরে বয়ে আসছে আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
‘কখনো আসেনি’তে সংগীতের সুর ও সংগীতে ছিলেন খান আতাউর রহমান। তার সাথে আরো গান গেয়েছেন কলিম শরাফী ও মাহবুবা রহমান। সিনেমায় অনেক দৃশ্যে পরিচালক মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ঢাকা শহরের দৃশ্য, বৃষ্টির দৃশ্য কিংবা গ্রামের দৃশ্য চমৎকার দ্যুতি ছড়িয়েছে।
জহির রায়হান ছিলেন সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা এবং আরও অনেক কিছু। তবে তার চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব পরিচয়টিই পূর্ণাঙ্গ। একজন চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের যা যা করার কথা তার সবই তিনি করেছেন। ১১ টি করে চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। তিনি গান লিখেছেন, অন্য পরিচালকের জন্য চিত্রনাট্যও লিখেছেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান বেঁচে থাকলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আজ অন্য এক উচ্চতায় থাকতো।
দেখুন: চলচ্চিত্র ও টিভি কে বদলে ফেলার ইঙ্গিত দিলেন নাহিদ ইসলাম