জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আচরণ নিয়ে বিস্তৃত তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটি ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়, যা ছাত্রলীগের সদস্যদেরকে উসকানি দিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমন করার বিষয়ে সরকারের উচ্চপদস্থ নেতাদের ভূমিকা বর্ণনা করেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই মাসে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং তা ক্রমেই ব্যাপক আকার ধারণ করে। আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উসকানি দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেনসহ অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতারা এই হামলা পরিচালনায় যুক্ত ছিলেন। ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমনে ব্যবহার করার পাশাপাশি পুলিশের ভূমিকা ছিল নির্বিকার এবং এ সময় পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত সশস্ত্র গ্রুপগুলো হামলা চালায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ১৪ জুলাই থেকে পরবর্তী দুইদিন ধরে ছাত্রদের ওপর এই সহিংসতা অব্যাহত ছিল এবং পুলিশ বাহিনী তার আক্রমণাত্মক ভূমিকা আরও বাড়িয়ে তোলে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পুলিশ বিভিন্ন ধরনের শক্তি ব্যবহার করে, যার মধ্যে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং কখনো কখনো গুলিবিদ্ধ বন্দুকের ব্যবহারও ছিল। তবে পুলিশের আক্রমণাত্মক ভূমিকায় জড়িত থাকার পাশাপাশি ছাত্রলীগের কর্মীরা আরও সহিংসতার ঘটনা ঘটায়।
আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের হামলার ফলে ১৬ জুলাইে অন্তত ছয়জন নিহত হন, যার মধ্যে একজন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ। তার হত্যার ভিডিওটি সামাজিক মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে, বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যোগ দেন। এর ফলস্বরূপ আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আন্দোলন দমনে পুলিশ ও আধাসামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করা হয়েছিল, এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সমর্থকদের বিক্ষোভ দমনে অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করে। যুবলীগসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখার সদস্যরা এসব হামলায় অংশ নেন। এ সময় পুলিশের সহায়তায় র্যাব ও বিজিবি’র সদস্যরা বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে, যারা সশস্ত্র অবস্থায় ছিল।
এছাড়া, দেশব্যাপী পুলিশ ও র্যাব বাহিনীর পাশাপাশি আনসার, ভিডিপি এবং বিজিবি বাহিনীও মোতায়েন করা হয়েছিল। র্যাবের ১৫টি ব্যাটালিয়ন, আনসারের অন্তত ১৪টি ব্যাটালিয়ন, এবং বিজিবির ৫৮টি স্থানে চার হাজার সদস্য পাঠানো হয়। এই বাহিনীগুলোর সদস্যরা শটগান ও রাইফেল ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়।
প্রতিবেদনে একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকারও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা থেকে জানা যায় যে, শেখ হাসিনা ও তার সিনিয়র কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে এসব নিরাপত্তা কর্মকাণ্ড তদারকি করছিলেন এবং তারা এই কর্মকাণ্ডের সশরীর এবং টেলিফোনে সরাসরি তদারকি করছিলেন।

এ ধরনের সহিংসতার পর সরকারের বিভিন্ন শাখার মধ্যে গভীর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সহিংসতা ও পুলিশ বাহিনীর রাজনৈতিকীকরণের বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের সহায়তায় আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালানোর মাধ্যমে সরকার জনগণের আন্দোলন দমন করার চেষ্টা করে।
এদিকে, সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, সরকার আরও বেশি সামরিক কৌশল গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করে সশস্ত্র বাহিনীকে মাঠে নামানো হয়েছিল। ২০ জুলাই থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেলও নিরাপত্তা কর্মকাণ্ডের তদারকি করতে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা ও তার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে সশরীরে ও টেলিফোনে শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন এবং তাদের কার্যক্রম সরাসরি তদারকি করতেন, যা সাবেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকার এবং ওএইচসিএইচআরকে সরবরাহ করা কললিস্ট থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
পড়ুন :জাতিসংঘের বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
দেখুন :রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্বিতীয় বছরে, বন্ধের আহবান জাতিসংঘের |
ইম/