বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফল হিসেবে পরিচিত কাঁঠাল উৎপাদনের দিক থেকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। জাতীয় ফল কাঁঠাল উৎপাদনে সারাদেশের মধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের তিন পাহাড়ি জেলার জৌলুস পুরনো। পাহাড়ে কাঁঠালের উৎপাদনও ক্রমবর্ধমান। পার্বত্য চট্টগ্রামের ঢালু পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির মৌসুমি ফলের সঙ্গে রয়েছে ছোট-বড় হাজারো কাঁঠাল বাগান। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হচ্ছে বান্দরবানে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে কাঁঠাল উৎপাদন সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে বান্দরবান। এরপর রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার অবস্থান। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বিগত ৫ বছরের আবাদ ও উৎপাদনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামে কাঁঠালের আবাদ ভূমি কমলেও ফলন উৎপাদন বেড়েছে।
চাষীরা জানান, মূলত বছরের এপ্রিল মাস অর্থাৎ গ্রীষ্মের শুরু থেকেই পার্বত্য অঞ্চলের হাটবাজারগুলোতে পাঁকা কাঁঠাল আসতে শুরু করে। মূলত সেগুলো আগাম ফলন হিসেবে পরিচিত। সাপ্তাহিক হাটবার ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে বাজারে কাঁঠাল আনেন স্থানীয় চাষীরা। এরপর এসব কাঁঠাল বাজার থেকে পাইকার দরে কিনছেন ঢাকা-চট্টগ্রামের পাইকারি ক্রেতারা। এরপর সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।
রাঙামাটি জেলা শহরে অবস্থিত মৌসুমির ফলের বাণিজ্যিককেন্দ্র বনরূপা সমতাঘাট, পৌর ট্রাক টার্নিমালে কাপ্তাই হ্রদ দিয়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় পরিবহন করে কাঁঠাল বাজারে নিয়ে আসেন। তবে হাটবারে বেশি আনা হয় এই মৌসুমি ফল। এছাড়া জেলার কুতুকছড়ি, ঘিলাছড়ি, ঘাগড়া, কাউখালী, কাপ্তাই, বাঙালহালিয়াসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে ক্রমাগত বাড়ছে মৌসুমি ফল কাঁঠালের উপস্থিতি। এটি প্রায় আষাঢ় পর্যন্ত থাকবে বলছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির প্রধান হাটবাজারগুলো এখন কাঁঠালে সয়লাব।
সম্প্রতি রাঙামাটি সদর উপজেলার কুতুকছড়ি বাজারে গিয়ে সরেজমিন দেখা যায়, রাঙামাটি সদর উপজেলার সাপছড়ি ইউনিয়নসহ নানিয়ারচর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন থেকে পাহাড়ি কৃষকরা বাজারে বিক্রয়ের জন্য এনেছেন। তাদের থেকে পাইকার ব্যবসায়ীরা এসব কাঁঠাল ক্রয় করবেন। কৃষকরা জানান, পাহাড়ের কাঁঠাল বাগানগুলোতে কাঁঠাল বিক্রয় উপযোগী হয়ে উঠেছে। কৃষকরা বাজারে কাঁঠাল এনে বিক্রয় শুরু করছেন। এটি আষাঢ় পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অনেকেই মৌসুম শুরুর আগেই পাইকার ক্রেতার কাছে বাগানও বিক্রয় করে দিয়েছেন।
স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার মাটি কাঁঠাল আবাদের উপযোগী। এছাড়া তিন পার্বত্য জেলার ২৬টি উপজেলার ঢালু পাহাড়ে সব ধরণের ফসল উৎপাদন করা যায়। ঢালু পাহাড়ে কাঁঠাল করা সহজলভ্য। সে কারণে অন্যান্য ফলন থেকে কাঁঠাল আবাদ সহজ ও খরচ দিক থেকেও সাশ্রয়ী।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ৯ হাজার ৪৪২ হেক্টর জমিতে কাঁঠাল আবাদ হয়েছে; এর বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৯৯৫ মেট্রিক টন। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯ হাজার ৪০৯ হেক্টরের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৬২ হাজার ৫০১ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ হাজার ১৬০ হেক্টরের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৯ হাজার ৬৫৯ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮ হাজার ৪৪২ হেক্টরের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৩০৯ মেট্রিক টন। সবশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৩৮৭ হেক্টরের বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৮৯ হাজার ৭৭০ টাকা। তবে চলতি বছরে কাঁঠালের মৌসুম মাত্র শুরু হওয়ায় এখনো ফলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেনি কৃষি বিভাগ। তবে কর্মকর্তাদের প্রত্যাশা, এবারও কাঁঠালের ফলন ভালো হয়েছে।
জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বান্দরবান কার্যালয়ের উপপরিচালক এমএম শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘বান্দরবান জেলার সব উপজেলাতেই কম-বেশি কাঁঠাল আবাদ ও উৎপাদন হচ্ছে। চলতি মৌসুমে বাজারে কাঁঠাল আসা শুরু হয়েছে। তবে পুরো জেলার মধ্যে রুমা, রোয়াংছড়ি, থানচি উপজেলায় কাঁঠাল উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে। লামা, আলীকদমের দিকে তুলনামূলক কম উৎপাদন হয়ে থাকে। লামা, আলীকদমের দিকে সমতল ভূমি বেশি থাকায় সেসব এলাকায় অন্যান্য ফসলের চাষ হয়, সেজন্য কাঁঠাল উৎপাদন কিছুটা কম হয়।’
ডিএই রাঙামাটি জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, জেলার সব উপজেলাতেই কাঁঠালের আবাদ হয়, তবে সদর, নানিয়ারচর, কাপ্তাই ও কাউখালীতে কিছুটা বেশি। এখন মূলত আগাম কাঁঠালগুলো বাজারে আসতে শুরু হয়েছে। সিজনাল কাঁঠাল আসতে আরেকটু সময় লাগবে, সেগুলো এখনো পরিপক্ক হয়নি। কাঁঠালসহ অন্যান্য মৌসুমি বিপণনের ক্ষেত্রে এখনো কোনো ধরণের প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়নি। সামনে সময়টাতে বোঝা যাবে কৃষক কেমন দাম পাচ্ছেন।
ডিএই রাঙামাটি অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) কৃষিবিদ মো. নাসিম হায়দার বলেন, কৃষকরা এখন আগে থেকে অনেক সচেতন। কিভাবে চাষাবাদ ও পরিচর্যা করতে হয়, সেগুলো এখন তারা ভালোভাবে শিখে গেছেন। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবানে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে। বান্দরবানে ক্রমাগত কাঁঠাল বাগান বাড়ছে এবং ফলনও বাড়ছে। বান্দরবানের কাঁঠালের একটা বড় অংশই সেখানে বেড়াতে পর্যটকরা ক্রয় করে থাকেন। উৎপাদন বাড়লেও বিভিন্ন সময়ে পর্যটকদের ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা পড়ায় এর প্রভাব কিছুটা বিপণনেও দেখা দিতে পারে।কৃষিবিদ নাসিম হায়দার আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণত দুই ধরণের কাঁঠাল গাছ চাষ হচ্ছে। একটি হলো গালা; আরেকটি হলো খাঁজা। তবে আসামি নামের আরেকটি প্রজাতি আছে। সেটি একদম শেষদিকে বাজারর আসে, আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে পেঁকে থাকে।
পড়ুন: নোয়াখালী জেলা জাতীয়তাবাদী আইনজীবি ফোরামের সভাপতি আবদুল হক
দেখুন: একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ
ইম