ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক দশকে ঢাবিতে বহু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তবে অধিকাংশের বিচার এখনও হয়নি। সর্বশেষ, মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদল নেতা শাহরিয়র আলম সাম্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। একদল দুর্বৃত্ত তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এ ঘটনা ক্যাম্পাসে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে এবং ছাত্রসমাজসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার দ্রুত বিচার দাবি করছে। এরই মধ্যে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তবে হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে পূর্বের অভিজ্ঞতা অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী বীরেন্দ্র কুমার সরকারকে ১৯৭৭ সালে হত্যা করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে বিরোধে তার সহপাঠী রণজিত মজুমদার তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করেন। কিন্তু এ মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এর মতো আরও অনেক হত্যা ঘটেছে, কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রায় সব ক্ষেত্রেই শেষ পরিণতি দেখা যায়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহরিয়া আফরিন বলেন, “নির্দিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে কোনো দৃশ্যমান ফল পাওয়া যায় না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি অপরাধী কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করে। এতে অপরাধ কমানোর পরিবর্তে আরও বেড়ে যায়।” তার মতে, সঠিক তদন্ত এবং পদক্ষেপ নেওয়া হলে এই ধরনের ঘটনা অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা একেবারে নতুন নয়। ১৯৭৪ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ঢাবি ক্যাম্পাসে ৬০টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের বেশিরভাগই রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, দলীয় কোন্দল, চাঁদাবাজি এবং মাদক সেবনের কারণে ঘটেছে। তবে এখনও পর্যন্ত কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়নি এবং অনেক মামলা এখনো তদন্তাধীন।
সর্বশেষ হত্যাকাণ্ড, শাহরিয়র আলম সাম্য হত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য তারা পুলিশের সঙ্গে একটি কমিটি গঠন করবেন। এ ছাড়া, উদ্যানে নতুন সিসিটিভি ক্যামেরা এবং পর্যাপ্ত আলো বসানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি আরও জানান, সাম্য হত্যার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং তারা ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করছেন যে, অতীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার হয়নি এবং অভিযুক্তরা বিচারের আওতায় আসেননি। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, “যতদিন পর্যন্ত বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকবে, ততদিন এসব হত্যাকাণ্ড ঘটতেই থাকবে।” তিনি আরও বলেন, ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদে অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তিরা বিচার থেকে বাঁচে এবং তাদের শাস্তি দেওয়া হয় না।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, “আমরা সব ধরণের চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত শেষ করা হয়। সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, “বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আমরা শক্ত অবস্থান নিব।” সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, “হত্যাকাণ্ড, হামলা এবং নারী নিপীড়নের ঘটনা বারবার ঘটছে, যা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাহীনতার বড় প্রমাণ।”
ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং সুষ্ঠু তদন্তের দাবি শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উঠছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং প্রশাসনের অদৃশ্য হস্তক্ষেপের কারণে এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার সম্ভব হচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং রাষ্ট্রকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় এবং ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকে।
পড়ুন: নারী সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ ধর্ম ও নারীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে : এনসিপি
দেখুন:নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি বিএনপি-এনসিপি
ইম/