বৃহস্পতিবার, ০২ জানুয়ারী, সকালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে বিভিন্ন স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্তে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত একটি তামাক বিরোধী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।
এই শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে শিক্ষার্থীরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের দাবী তুলে ধরেন। যেমন- সকল পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির যেকোনো ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট/কৌটায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা, মোড়কবিহীন এবং খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং ই-সিগারেটসহ সকল ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস্ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা।
শোভাযাত্রায় আংশগ্রহণকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যান্টি টোব্যাকো ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট, মোঃ হৃদয় বলেন, টোব্যাকো এটলাস ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসেবে প্রতিদিন ৪৪২টি প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। তামাকের কারণে বিভিন্ন রোগ যেমন- হৃদ্রোগ, ফুসফুস, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ এবং আঘাতজনিত রোগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য মতে, তামাকের কারনে সৃষ্ট রোগের কারনে তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা অকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে। এই অকাল মৃত্যুরোধ হ্রাসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী এখনই পাশ করতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যেখানে এই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রনের ছয়টি আইন দ্রুত পাস করা জরুরি সেখানে তামাক কোম্পানিগুলোর নানা রকম মিথ্যাচার এটিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী হলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে বলে তামাক কোম্পানি প্রচারণা চালাচ্ছে, যা মোটেও যুক্তিসংগত নয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌমিতা বালা বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০০৫ সালে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়, সে বছর তামাক থেকে রাজস্ব আয় ছিল দুই হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছর ২০০৫-০৬ এ রাজস্ব আদায় হয় তিন হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যখন আইনটি সংশোধন করা হয়, সেই বছর তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ১০ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। ফলে তরুণ প্রজন্ম রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তামাকের ব্যবহার কমবে। এমন বাস্তবতাকে এড়িয়ে তামাক কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র, মোঃ সিফাত রহমা্মা বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছে। কোম্পানির দাবি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এটি বাস্তবতার নিরিখে অযৌক্তিক। কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শুধু সিগারেট বিক্রি করা ছাড়াও নানা রকম পণ্য বিক্রি করেন। তাই একটি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশে ক্ষতিকর এই পণ্যের ব্যবহারের হার কমবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হলে দেশে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে । অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশে বিড়ি কোম্পানিতে শ্রমিক নিয়োজিত আছে মাত্র ৪৬ হাজার। আর দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে দুই বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবি ও জেটিআই। তামাক কোম্পানির প্রতিবেদন অনুসারে তাদের কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৬৯ জন (বিএটিবির ১ হাজার ৬৬৯ জন এবং জেটিআইয়ের প্রায় ১০০ জন)। অতএব সিগারেট কোম্পানিগুলো ৭০ লাখ লোক কাজ হারাবে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্লাবের নেতৃত্বদানকারি সাদিয়া নেয়ামত বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তামাক কোম্পানি গুলোকে এখনো আইনের আওতায় না এনে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC) আর্টিকেল ৫.৩ এ তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকারকে তামাক কোম্পানির প্রভাবমুক্ত থাকতে সুপারিশ করা হয়েছে। তাই তামাক কোম্পানির বিভিন্ন কার্যকলাপে বিভ্রান্ত না হয়ে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা চিন্তা করে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী দ্রুত পাসের দাবিতে আজ আমরা একত্রিত হয়েছি।
তরুণদের এই মানববন্ধনের আয়োজনে সাধুবাদ জানিয়ে ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে)-এর অ্যাডভোকেসি ম্যানেজার, জনাব আতাউর রহমান বলেন, তামাক কোম্পানির নানান রকম প্রচার প্রচারণা তরুণদের ধূমপানে আসক্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্বিগুণ। গ্লোবাল ইয়ুথ টোব্যাকো জরিপের তথ্যমতে ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশে ধূমপান আসক্ত কিশোর-কিশোরীর হার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ১২ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নিয়মিত ধূমপানে আসক্ত। যুব সমাজই সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঢাল। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষায় তরুণ সমাজকে তামাক কোম্পানির সকল কূটকৌশল এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এই শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে জীবন রক্ষায় তামাক বিরোধী আইন শক্তিশালীকরন এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ছয়টি ধারা দ্রুত বাস্তবায়নের জোর দাবী জানানো হয়, ই-সিগারেট নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন অতি দ্রুত বাস্তবায়নের দাবী জানানো হয় এবং তামাক বিরোধী কার্যক্রমকে সুদূঢ় করতে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার কে কঠুর পদক্ষেপ নেয়ার দাবী জানানো হয়।
এনএ/