আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের কিছু আইন, মানুষের জীবনযাত্রা এবং সামাজিক আচরণকে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে নারীদের জীবনযাপনে এসব বিধিনিষেধ কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকেই আফগানিস্তানে নারীদের ওপর বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা শুরু হয়।
এবার আইনের মাধ্যমে তা আরও কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোয় কথিত নীতি পুলিশের সদস্যদের আইনটি কার্যকরে মাঠে নামতেও দেখা গেছে। পাশাপাশি তালেবান সরকারের সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হওয়ার ভয়ে আফগানরা নিজেরাও বিধিনিষেধ মেনে চলার চেষ্টা করছেন।
তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার অনুমোদিত আইন, যেখানে বলা হয়েছে যে নারীদের শরীরের কোনও অংশ যেন দেখা না যায়। এমনকি তাদের কণ্ঠস্বরও জনসমক্ষে শোনা যাবে না, কারণ তালেবানরা মনে করে নারীদের কণ্ঠও প্রলোভন ও পাপের কারণ হতে পারে। ঘরের ভেতরেও নারীদের গান গাওয়া বা উচ্চস্বরে পড়াশোনা করা নিষেধ করা হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী, নারীদের জনসমক্ষে শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে হবে। এর মধ্যে তাদের মুখও ঢেকে রাখতে হবে।
অনেক আগেই আফগান নারীদের স্কুলে যাওয়া, চাকরি করা বা জনজীবনের কোনও ক্ষেত্রে অংশগ্রহণও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির পর থেকে মেয়েদের স্কুলে যেতে পারবে না, এবং মহিলাদের বেসরকারি সংস্থায় কাজ করাও নিষিদ্ধ করা হয়েছে এই আইনে। তালেবান সরকার মহিলাদের জন্য বিউটি সেলুন বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের জিমে যাওয়া কিংবা পার্কে প্রবেশ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এমনকি কোন ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া ও পুরুষ অভিভাবক ছাড়া নারীরা বাইরে যেতে পারবেন না।
এই কঠোর আইন শুধু নারীদের জন্য নয়, পুরুষদের জন্যও কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে। যেমন পুরুষদের জন্যও পোশাক এবং দাড়ির দৈর্ঘ্যের বিষয়ে নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হবে। এছাড়াও, সমকামিতা, পশুর লড়াই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, অমুসলিম ধর্মীয় উৎসব পালন, গান-বাজনা, এবং আতশবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার করার ক্ষেত্রেও রয়েছে বিধি-নিষেধ।
তালেবান সরকারের আরোপ করা নীতিগুলোও রেখে গেছে কিছু প্রশ্নবিদ্ধ আলোচনা। তালেবান সরকার নারীদের বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারগুলোকেও কেড়ে নিচ্ছে। নীতি আনুযায়ী নারীরা ‘জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া বাইরে বের হতে পারবে না। তবে প্রশ্ন হচ্ছে ‘জরুরি প্রয়োজন’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা আইনটিতে স্পষ্ট করা হয়নি। ফলে নারীরা একপ্রকার গৃহবন্দী জীবন কাটাতে বাধ্য।
ক্ষমতায় আসার সময় তালেবান প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে তারা নারীদের অধিকার কিছুটা হলেও রক্ষা করবে এবং নারীদের জন্য কিছু বিষয় শিথিল রাখা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। নারী ও মেয়েদের প্রায় সব ক্ষেত্রেই পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। জনজীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্র থেকে নারী ও মেয়েদের বিতাড়িত করা হয়েছে।
তালেবান সরকারের নতুন আইনটি প্রকাশের পর থেকে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর কঠোর সমালোচনা করেছে। তারা বলছে, তালেবানদের ক্ষমতায় আসার আগে আফগান নারীরা যেসব অধিকার ও স্বাধীনতা অর্জন করেছিল, তা এখন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এই আইনের মাধ্যমে নারীদের জনজীবন থেকে একপ্রকার সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যাওয়ার পর তালেবান সরকার ক্ষমতায় ফিরে আসে। তারা ক্ষমতায় আসার পর থেকেই নারীদের পোশাক, শিক্ষা, কাজ এবং জনজীবনে অংশগ্রহণের উপর কঠোর নিয়ম আরোপ করে। এবার নতুন আইনের অধীনে নারীদের আরও বেশি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।
আফগানিস্তানের মানুষ এই কঠোর নিয়মগুলো মানতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ তারা তালেবানদের ভয়ে নিয়ম ভাঙার সাহস পাচ্ছে না। নীতি পুলিশের সদস্যরা নিয়ম কার্যকরে মাঠে রয়েছে, ফলে কেউ যদি এই বিধিনিষেধ অমান্য করে, তাহলে তার জন্য শাস্তির ভয়ও কাজ করছে।
তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই নতুন আইনটি কতটা কঠোরভাবে এবং সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে? কারণ তালেবান সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ বিদ্যমান। এই দ্বন্দ্বের ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তালেবানের নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয় না।
তালেবানের কঠোর নীতি আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। নারীদের জীবন থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে পারে। আফগানদের জীবনে এই কঠোর বিধিনিষেধের বাস্তবায়ন আন্তর্জাতিক পরিসরেও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, এবং এর প্রভাব আফগানিস্তানের বাইরে, বিশ্বমঞ্চেও পড়তে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।