24.9 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৭, ২০২৫

২০২৪: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে এক নবদিগন্তের সূচনা হয়েছিলো। দেড় হাজারের অধিক নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সৃজিত হয়েছে নতুন ইতিহাস। যুগান্তকারী এই ইতিহাস বিনির্মাণে অংশ নিয়েছে জাতি-ধর্ম-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ।

২০২৪: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা
২০২৪: জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশের ইতিহাসে নবদিগন্তের সূচনা

৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে যেমন যাপিয়ে পড়ে বাঙ্গালী এক নবদিগন্তের নতুন সূর্য চিনিয়ে এনোছিলো। তেমনি ২৪ এর জুলাই-আগস্টে পরাজিত হয়েছিলো কতৃত্ববাদি এক শাসকের।

মূলত এই ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয় সরকারি চাকরিতে বৈষম্য দূর করে কোটা সংস্কারের দাবিতে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এ দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে।

বস্তুত ২০২৪ সালের ১ জুলাই কোটা সংস্কারের লক্ষ্যে চার দফা দাবিতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লাগাতার কর্মসূচি দেয়। ২ থেকে ৬ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মহাসড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।

৭ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাকায় গণপরিবহন বন্ধ এবং রাস্তা অবরোধ কর্মসূচি চালায় এবং পরবর্তীতে সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি দেয়া হয় যা “বাংলা ব্লকেড” কর্মসূচি নামে পরিচিতি পায়।

পরবর্তীতে কর্মসূচিটি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এইসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগ ও পুলিশি হামলার শিকার হয়।

১৪ জুলাই। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ঢাকায় গণপদযাত্রা করে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে। এদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তব্যে কোটা আন্দোলনকারীদের “রাজাকারের নাতি-পুতি” হিসেবে অভিহিত করেন।

প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হিসেবে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা ব্যঙ্গ করে “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার” সহ নানা স্লোগান। এইদিন দিবাগত রাতে আবারও উত্তাল হয় আন্দোলনের মাঠ। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাহার চান

পরের দিন অর্থাৎ ১৫ জুলাই আওয়ামীলীগ ও তৎকালীন সরকারের মন্ত্রীরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নষ্ট করার অভিযোগ আনেন। ঐদিনে সমন্বয়করা ঘোষণা দেন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। 

১৬ই জুলাই। আন্দোলন চলাকালে একজন পুলিশ সদস্যের গুলিতে মৃত্যুবরণ আবু সাঈদ। পরের দিনই ঘোষণা করা হয় ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির। এরই মধ্যে ১৮ জুলাই মারা যান মুগ্ধ। আবু সাঈদ এবং মুগ্ধের মৃত্যুতে ব্যাপক ক্ষোভের দাগ কাটে সাধারণের মনে। আন্দোলন আরো বেগবান হয়।

১৯ জুলাইতেও সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অবরোধ চলে। এদিন মধ্যরাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে আটক করা হয়।

একদিকে নাহিদ ইসলামকে আটক অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির সাথে সরকারের প্রতিনিধির একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় যেখানে তারা সরকারের কাছে ‘আট দফা দাবি’ জানান। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে আলোচনায় অংশ নেন সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সহ-সমন্বয়ক তানভীর আহমেদ।

সরকারের তরফ থেকে ফাটল ধরনোর চেষ্টা করা হয় আন্দোলনকারীদের মধ্যে। কিন্তু সফলতা আসেনি তৎকালীন সরকারের চেষ্টায়।

২১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি পক্ষ ‘৯ দফা’ দাবি জানিয়ে শাটডাউন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। ২২ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম চার দফা ইন্টারনেট চালু, ক্যাম্পাসগুলো থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রত্যাহার করে ক্যাম্পাস চালু, সমন্বয়ক ও আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা প্রদান এবং কারফিউ প্রত্যাহারের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি স্থগিত করেন।

১৯ জুলাই থেকে নিখোঁজ থাকার পর ২৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও রিফাত রশীদের খোঁজ পাওয়া যায়।

এরইমধ্যে ২৬ জুলাই নাহিদ ইসলামসহ কোটা সংস্কার আন্দোলনের তিন সমন্বয়ককে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদাপোশাকের এক দল ব্যক্তি।

পরের দিন ২৭ জুলাই সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহকে হেফাজতে নেয় গোয়েন্দা শাখা। অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে ২৮ তারিখের মধ্যে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদসহ আটক সকল শিক্ষার্থীদের মুক্তি, মামলা প্রত্যাহার ও শিক্ষার্থী গণহত্যার সাথে জড়িত মন্ত্রী পর্যায় থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সকল দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আল্টিমেটাম দেয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা।

২৮ জুলাই রাত ১০টার দিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা ৬ সমন্বয়ক আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। কিন্তু পুলিশে আটক হওয়া অবস্থায় পুলিশের অফিসে বসেই বাকি সমন্বয়কারীদের সাথে যোগাযোগ না করে এমন ঘোষণা দেয়ায় এটিকে সরকার ও পুলিশের চাপে দেয়া হয়েছে বলে আখ্যায়িত করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয় বাকিরা।

৩১ জুলাই। হত্যা, গণগ্রেপ্তার, হামলা, মামলা ও গুমের প্রতিবাদে সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে। পরের দিনেই ছেড়ে দেয়া হয় গোয়েন্দা হেফাজতে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে।

২ আগস্ট শুক্রবার। ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ কর্মসূচি পালন করা হয়। ৩ আগষ্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেয়া হয় অসহযোগ আন্দোলনের রূপরেখা। চলতে থাকে অসহযোগ আন্দোলন।

এরপরেই ৬ই আগস্ট বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন “লং মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচি ঘোষণা করে। তবেপরিস্থিতি বিবেচনায় সমন্বয়করা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে এনে ৫ই আগস্ট ঘোষণা করেন। আন্দোলনকে ঘিরে ৫ আগস্ট অনেক জেলায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটে, এতে নিহত হন হাজারেরও বেশি আন্দোলনকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থকরা।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে সম্মিলিত ছাত্র-জনতার এক গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করেন এবং দেশ থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেন, ভারতে। এরই মধ্য দিয়ে তার ১৫ বছরেরও বেশি সময়ের কতৃত্ববাদী এক শাসনের অবসান ঘটে। নবদিগন্তের সূচিত হয় এক নতুন বাংলাদেশের।

টিএ/

দেখুন: দেশে ফেরার প্রক্রিয়া শুরু হলো হাসিনার?

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ প্রতিবেদন