পাকিস্তানে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন তেহরিক–ই–তালেবানে (টিটিপি) যোগ দিয়ে সেনা অভিযানে নিহত বাংলাদেশি তরুণ ফয়সাল হোসেনের (২৩) পরিবার জানত তার ছেলে গেছে কাজ করার জন্য। ফয়সালের মৃত্যুতে তাঁর গ্রামের বাড়িতে চলছে মাতম।এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে তাঁর মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না পরিবারের লোকজনেরা।
মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নে ছোট দুধখালী এলাকার আবদুল আউয়াল মোড়লের ছেলে ফয়সাল। তাঁর পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর জগন্নাথপুরে বসবাস করেন।নিহতের বাবা পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁর বড় ভাই আরমান মোড়ল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
গত শুক্রবার রাতে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কারাক জেলায় পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে ১৭ টিটিপি সদস্য নিহত হন। এ সময় বাংলাদেশি তরুণ ফয়সাল হোসেন নিহত হন। রোববার রাতে নিহত তরুণের বড় ভাই আরমান মোড়ল তাঁর ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছেন।
সোমবার(২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরের দিকে ফয়সালের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জানা যায়, ফয়সালের পরিবারের সদস্যরা ভোরে ঢাকা থেকে মাদারীপুরের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। ১১টার দিকে ফয়সালের মা চায়না বেগম (৪৫) বাড়িতে প্রবেশ করেন। তখনো তিনি জানতেন না তাঁর ছোট ছেলে ফয়সাল মারা গেছেন।
তিনি শুনেছিলেন, তাঁর ছেলে দুবাইতে অসুস্থ। ফয়সালের মৃত্যুর খবরটি তাঁর নানা জয়নাল ব্যাপারী প্রথম জানালে তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। প্রতিবেশীরা দ্রুতই বাড়িতে ভিড় করতে শুরু করেন। তাঁরা ফয়সালের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ফয়সালের মা ও স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। নিহত ফয়সাল হোসেনের গ্রামের বাড়িতে প্রতিবেশীরা ভিড় করেছেন।
ফয়সালের মা চায়না বেগম কান্নাজনিত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলের লগে দুই মাস আগে কথা হইছে। তখন ছেলে কইলো, “মা, টাকাপয়সা তো তেমন পাঠাতে পারতাছি না। তুমি কেমন আছো, আমি এখানে খুব ভালো আছি। বলছে কয়েক মাসের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে।
” কিন্তু আর তো ফিরা আইলো না। হায় আল্লাহ, তুমি আমার বাবারে আমার বুকে ফিরাইয়া দাও।’ এদিকে নিহতের পরিবার কেউই জানতাম না যে ও পাকিস্তান গেছে।’
ফয়সাল ঢাকার কালাচাঁদপুরে একটি স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিলেন। বাংলাদেশে থাকতে তিনি ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ওয়াজ মাহফিলে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়ে তসবি, জায়নামাজ, আতর ও টুপি বিক্রি করতেন বলে জানায় পরিবার।
ফয়সালের চাচা আবদুল হালিম বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে দুই বছর আগে ফয়সাল বিদেশ যাওয়ার কথা বলে আর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখেনি। কয়েক মাস পরে পুলিশ আমাদের বাড়িতে আসে তারপরে পুলিশ বলে সে পাকিস্তান গেছে তারপর থেকে আমরা তার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।
নিহত ফয়সালের দাদা শুক্কুর মোড়ল বলেন, ‘আমার দুই মেয়ে ছয় ছেলে। নয়জন নাতি আমার। ফয়সাল সব নাতিপুতির মধ্যে সেরা ছিল। এক ওয়াক্ত নামাজও বাদ দিত না। নাতিটা খুব ভালো ছিল। এ পথে গিয়ে মারা গেছে, সেটা কল্পনাও করতে পারতাছি না।
ফয়সালের নানা জয়নাল ব্যাপারী কোনোভাবেই নাতির মৃত্যুর কথা মানতে পারছেন না। এইভাবে আমার নাতি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে এটা কখনোই কল্পনাই করি নাই। আমার সকল নাতির ভিতর ও সবচাইতে ভালো নাতী ছিল। ধর্মীয় আতর টুপি বিক্রি করতো সৎপথে থাকতে সব সময়।
ফয়সালের লাশ দেশে আনার দাবি জানিয়েছে তাঁর পরিবার ও স্থানীয় লোকজন। প্রতিবেশী কবিতা বেগম বলেন, সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি দেখতে চাই সরকার জানি লাশটা একটু দেশে আনার ব্যবস্থা করে আর যারা ফয়সালের সাথে কাজগুলো করছে তাদের জন্য বিচার হয়।
ফয়সালের মৃত্যুর সংবাদটি গুরুত্ব দিয়ে প্রথম প্রকাশ করে দ্য ডিসেন্ট নামে একটি অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম। পরে বিষয়টি আলোচনায় আসে। গণমাধ্যমটির সম্পাদক কদরুদ্দিন শিশির বলেন, ‘পাকিস্তানভিত্তিক সাংবাদিক জাওয়াদ ইউসুফ তাঁর টুইটার অ্যাকাউন্টে নিহত বাংলাদেশির ছবি প্রকাশ করেন। পরে আমরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হই। পরে আমরা বাংলাদেশে নিহত তরুণের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে শতভাগ নিশ্চিত হই। এর আগেও বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে টিটিপির হয়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, সেই সংবাদও আমরা করেছি।’
দ্য ডিসেন্টের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল উত্তর ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বোমা হামলায় টিটিপির ৫৪ জন সদস্যের সঙ্গে আহমেদ জোবায়ের নামের এক বাংলাদেশি নিহত হয়েছিলেন। গত এক বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে অন্তত চারজন বাংলাদেশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনার পর পাকিস্তানের টিটিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গত জুলাই মাসে বাংলাদেশে অন্তত দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
জানতে চাইলে মাদারীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ ও অনুসন্ধান) জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জঙ্গি হামলায় মাদারীপুরের এক তরুণ মারা গেছে বলে আমরা জেনেছি। তাঁর পরিবার যদি আমাদের কাছে আইনগত সহায়তা চায়, তাহলে পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা সেটা অবশ্যই করব। পাকিস্তান থেকে নিহত তরুণের লাশ ফেরত আনার যদি কোনো ব্যবস্থা থাকে, সেটাও করা হবে।
পড়ুন :মাদারীপুরে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন, ওসিসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ


