সাত দিনের ছোট্ট শিশু। নাম পর্যন্ত রাখা হয়নি এখনও। প্রো-অ্যাকটিভ হাসপাতালে ভর্তি। রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। ডাক্তার বললেন, ফ্রেশ প্লাজমা প্রয়োজন। ভাতিজার রক্তের জন্যে মধ্যরাতে চাচা আবুল কালাম ছুটে আসেন রাজধানীর শান্তিনগরের কোয়ান্টাম ল্যাবে।

দাদি রাঙ্গা বালা দেবনাথের অপারেশনের জন্যে এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। মধ্যরাতে নাতি দীপক দেবনাথও চলে আসেন কোয়ান্টামে। বি পজেটিভ গ্রুপের রেড সেলের ব্যাগটি হাতে পান রাত দেড়টায়। রক্ত নিয়ে ছুটে যান হাসপাতালের দিকে।
১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এমনই চিত্র দেখা যায় স্বেচ্ছাসেবী সঙ্ঘ কোয়ান্টাম ল্যাবে। সারাদিনের ব্যস্ত রাজধানী যখন মধ্যরাতের ঘুমে বিভোর তখনও জরুরি রক্তের এমন লেন-দেন চলে ব্লাড ল্যাবগুলোতে। জেগে থেকে রোগীর রক্তের চাহিদা মেটায় রোগীর স্বজন ও রক্তসংশ্লিষ্ট সেবকেরা।

রক্ত সংগ্রহে আসা দীপক দেবনাথ জানান, অনেক খোঁজাখুজি করেও এত রাতে কোনো ডোনার পান নি তিনি। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার বললেন কোয়ান্টামের নাম। আশা করে এসে ঘণ্টা দেড়েক পরে মিলে গেল কাঙ্ক্ষিত রক্ত। প্রিয়জনের জন্যে প্রয়োজনীয় রক্ত পেয়ে খুশিমনে ফিরলেন তিনি। রক্ত দিলে দাদির হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক হবে। এরপর অপারেশন।
বাচ্চা শিশুটির অবস্থা বেশি ভালো না থাকায় ডাক্তার সাজেশন করলেন অতি দ্রুত রক্ত দিতে। কোয়ান্টামের ২৪ ঘন্টা সেবা থাকায় মধ্যরাতে এসে প্লাজমা পেয়ে রোগীর স্বজনেরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে।

বিশ্ব রক্তদাতা দিবস আজ
এভাবেই কোয়ান্টামের মতো দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকা ল্যাবে শুধু দিনের বেলা নয়; মধ্যরাতেও স্বজনদের উপস্থিতি থাকে এক ব্যাগ রক্তের জন্যে। মুমূর্ষু মানুষের জীবন বাঁচাতে ল্যাবের সেবাদানকারী সেবকেরাও জেগে থাকেন রক্ত সেবা দিতে। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে নীরব ভূমিকা পালন করেন মহৎ হৃদয়ের অধিকারী স্বেচ্ছা রক্তদাতারা। মধ্যরাতেও যাদের দান করা এক ব্যাগ রক্তে হেসে ওঠে অসংখ্য রোগী। আর মধ্যরাতের সেই মানবিক শুভ কামনাও নিশ্চয়ই নীরবে পৌঁছে যায় স্বেচ্ছা রক্তদাতার কাছে।
এমন প্রেক্ষাপটেই আজ ১৪ জুন সারাবিশ্বে পালিত হচ্ছে বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। এ দিনটি আসলে স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের ধন্যবাদ জানানোর দিন। লক্ষ লক্ষ উদার স্বেচ্ছাসেবক ও মানবিক স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের প্রতি বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা জানানোর দিন। এ বছর এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে- ‘Give blood, give hope: together we save lives’। সহজ বাংলা করলে দাঁড়ায়- ‘রক্ত দিই, আশা জাগাই : সবাই মিলে জীবন বাঁচাই’।
আমাদের দেশে পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের উপর নির্ভরতা দিন দিন কমছে, স্বজনদের দানের পরিমাণও বেড়েছে। তবে প্রয়োজনীয় রক্তের চাহিদা আমরা এখনও মেটাতে পারছি না। অথচ রক্তদানের জন্যে ঐকান্তিক ইচ্ছাই যথেষ্ট। ধর্মীয়ভাবেও এ দান অত্যন্ত পূণ্যের কাজ। আর সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে রক্তচাহিদা পূরণে সঙ্ঘবদ্ধ সচেতনতাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। একটি জনগোষ্ঠীর অল্প কিছু অংশ সামর্থ্যবান মানুষ যদি নিয়মিত রক্তদান করেন তাহলেই রক্তের অভাবে কোনো মানুষের মৃত্যু হয় না। নিয়মিত ছোট্ট এই দান নতুন করে হাসি ফোটাতে পারে লাখো মানুষের জীবনে।
সাধারণত থ্যালাসেমিয়া ছাড়াও রক্তস্বল্পতা, প্রসূতির রক্তক্ষরণ, অগ্নিদগ্ধ রোগী, বড় অপারেশন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি নানা কারণে রক্তের প্রয়োজন হয়। রক্তের কোনো বিকল্প নেই। রক্তের প্রয়োজনে রক্তই দিতে হয়। শারীরিক মানসিকভাবে আপাত সুস্থ ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী যেকোনো সক্ষম ব্যক্তি প্রতি চার মাস পরপর রক্ত দিতে পারেন। নিয়মিত রক্তদানে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণেরও বেশি কমে যায়। এমনকি আত্মিক-আধ্যাত্মিকভাবেও এর উপকার লাভ করেন দাতা।
বাংলাদেশে বছরে রক্তের চাহিদা আনুমানিক ১০ লক্ষাধিক ইউনিট। অথচ দেশের জনসংখ্যার তুলনায় রক্তের এ চাহিদা একেবারেই নগণ্য। তা হলেও এখনও আমরা স্বেচ্ছা রক্তদানে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে যেহেতু কেবল রক্তই দিতে হয়; সেহেতু ব্যাপক জনসচেতনতার মাধ্যমে স্বেচ্ছা রক্তদাতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই রক্তের এ চাহিদা মেটানো সম্ভব। রক্তদাতাদের দানকৃত রক্তের ফোঁটায় ফোঁটায় বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ রোগীর মাঝে প্রবাহিত হোক নতুন আশা, নতুন জীবন। রক্তদাতা দিবসে সকল স্বেচ্ছা রক্তদাতার প্রতি গভীর শুভেচ্ছা।
দেখুন: বিশ্ব রক্তদাতা দিবস আজ