একসময়ের প্রথাগত ‘শ্রমিক’ পরিচয় এখন অতীত। সৌদি আরবের মতো বড় শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী, প্রবাস গমনেচ্ছুদের এখন দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হচ্ছে। আর এই নতুন বাস্তবতার নাম ‘তাকামুল পরীক্ষা’। সম্প্রতি যশোরের কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে (টিটিসি) এই পরীক্ষা চালু হওয়ায় শুধু প্রবাস যাত্রার ভোগান্তিই কমেনি, বরং দেশের ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের জন্য এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। যা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।
এই পরিক্ষার মাধ্যমে সৌদি সরকার সরাসরি দক্ষ কর্মী নির্বাচিত করতে পারছে, এতে যেমন দক্ষ জনবল দেশ থেকে প্রবাসে যাচ্ছে, তেমনি দালাল চক্রের দৌরাত্ম কমছে বলে মনে করছেন কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র যশোরের অধ্যাক্ষ প্রকৌশলী কাজী ইরফাত মাহমুদ।
তিনি টাইমস অফ বাংলাদেশকে বলেন, দেশে ১৭টি কেন্দ্রে তাকামুল সেন্টার রয়েছে। তবে যশোরে চলতি বছরের আগস্টের ৩০ তারিখ এই সেন্টারের যাত্রা শুরু হয়। এখন পর্যন্ত ৩০০’র অধিক প্রবাস গমনেচ্ছু এই কেন্দ্রে পরিক্ষা দিয়েছেন। এতে দক্ষিণ অঞ্চলের প্রবাস গমনেচ্ছুদের অর্থ, কষ্ট এবং সময় লাঘব হয়েছে। পাশাপাশি অনলাইনে দক্ষতার পরিক্ষা দিয়ে সরাসরি সৌদি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রেখে কর্মীরা তাদের গন্তব্যে পৌছাতে পারছেন। তবে এই মূহুর্তে যশোরে লোডার- আনলোডার এই ১টি বিভাগ চালু রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, তাকামুল পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত ফি হলো ৫০ মার্কিন ডলার (USD)। এই ফি সরাসরি সৌদি সরকার অনুমোদিত সংস্থা তাকামুলকে অনলাইনে জমা দিতে হয়। সেখান থেকে একটি অংশ তাকামুল কেন্দ্র পায়।
শনিবার (১৩ আগস্ট) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, যশোর টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) পরিণত হয়েছে প্রবাস গমনেচ্ছুদের দক্ষতা যাচাইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে। সকাল ৯টা। টিটিসি’র ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল সাজানো-গোছানো একটি হলরুম, যা দেখতে অনেকটা ছোটখাটো ওয়ার্কশপের মতো। ভেতরে কয়েকজন তরুণ হলুদ রঙের হেলমেট এবং নিরাপত্তা জ্যাকেট পরে গভীর মনোযোগে কাজ করছেন। তাদের কেউ ফর্কলিফ্ট দিয়ে ভারী বাক্স সরাচ্ছেন, কেউবা হ্যান্ড প্যালেট ট্রাক ব্যবহার করে পণ্য ওঠানামা করাচ্ছেন। এই কর্মযজ্ঞের নামই ‘তাকামুল পরীক্ষা’।
পরিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সৌদি আরবের শ্রমবাজারের নতুন নিয়ম অনুযায়ী, নির্দিষ্ট কিছু পেশায় দক্ষ শ্রমিকদের জন্য এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। এর আগে, এখানকার প্রবাস গমনেচ্ছুদের এই পরীক্ষা দিতে ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরে যেতে হতো। এতে যাতায়াত ও থাকার খরচ মিলিয়ে অতিরিক্ত প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা ব্যয় হতো। ফলে ভোগান্তি বাড়ত।
এখন সেই চিত্র পুরোপুরি পাল্টে গেছে। রাকিব হোসেন নামে এক পরীক্ষার্থী জানান, আগে কোথায় পরীক্ষা দেবো, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকতাম। এখন নিজ শহরেই পরীক্ষা দিতে পারছি, যা আমার জন্য অনেক সহজ হয়েছে। এতে টাকা ও সময় দুটোই সাশ্রয় হচ্ছে।
টিটিসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাকামুল পরীক্ষাটি দুই ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথম ধাপে কম্পিউটার-ভিত্তিক কিছু প্রশ্ন থাকে, যার মাধ্যমে প্রার্থীর তাত্ত্বিক জ্ঞান যাচাই করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা, একজন পরীক্ষক সার্বক্ষণিক উপস্থিত থেকে প্রার্থীদের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন এবং নিরাপত্তা নিয়মাবলী সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করেন।
সৌদি আরব তাদের শ্রমবাজারকে আধুনিক ও উৎপাদনশীল করতে বদ্ধপরিকর। অদক্ষ শ্রমিকের কারণে কাজের মান হ্রাস, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতা কমে যাওয়াসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে, তাকামুল পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ ফিল্টার হিসেবে কাজ করছে। এটি নিশ্চিত করে যে, কেবল তারাই সৌদিতে কাজের সুযোগ পাবেন, যাদের হাতে-কলমে দক্ষতা রয়েছে। এর ফলে, একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রের মান উন্নত হবে, তেমনি অন্যদিকে শ্রমিকদের বেতন ও সম্মানও বাড়বে।
যদিও তাকামুল পরীক্ষা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবুও এর কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে জানিয়েছেন টিটিসির অধ্যাক্ষ প্রকৌশলী কাজী ইরফাত মাহমুদ । তিনি বলেন, পরীক্ষার ফি, প্রক্রিয়াগত জটিলতা এবং পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অভাব এখনও অনেক কর্মীর জন্য একটি বাধা। তবে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, এই পরীক্ষা চালু হওয়ায় আমরা নিশ্চিত করতে পারছি যে, শুধুমাত্র যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীরাই বিদেশে যাচ্ছেন। এর ফলে একদিকে যেমন দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, তেমনি প্রবাসীদের আয়ও বাড়ছে। ভবিষ্যতে এই কেন্দ্রকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই ধরনের দক্ষতা যাচাই পরীক্ষাকে আরও সহজলভ্য করা। শুধু সৌদি আরব নয়, অন্যান্য দেশেও এমন পরীক্ষা চালু হতে পারে, যার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের উপর নির্ভরশীল। তাই, প্রবাসে শুধু কর্মী পাঠানো নয়, বরং দক্ষ কর্মী পাঠানোর উপর গুরুত্ব দেওয়া এখন সময়ের দাবি। তাকামুল পরীক্ষা সেই লক্ষ্যের দিকেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
পড়ুন: বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে যশোরে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত
এস/

