23 C
Dhaka
বুধবার, নভেম্বর ৬, ২০২৪
বিজ্ঞাপন

রাউজানের ক্ষমতাধর ‘সুলতানের’ পতন

বিজ্ঞাপন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আসনে টানা পঞ্চমবার সংসদ সদস্য ছিলেন। তার ‘অনুমতি’ ছাড়া রাউজানে ভোট করার সাহস কারও ছিল না। ১০ বছর ৬ লাখের বেশি ভোটার পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ পায়নি।  

তার ‘অনুমতি’ ছাড়া এলাকায় ভোট করার সাহস কারও ছিল না। তার কথাই ছিল আইন। তিনিই ছিলেন ‘নির্বাচন কমিশনার’। যোগ্যপ্রার্থীদের আগ্রহ থাকলেও ‘তার’ মতের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনের আগে এই উপজেলায় হত সমঝোতা বৈঠক। সেই বৈঠকে যে প্রার্থীকে চূড়ান্ত করা হয় তিনিই বনে যেতেন বিনা ভোটের জনপ্রতিনিধি। ক্ষমতাধর যে ব্যক্তির কথা বলা হচ্ছে তিনি হলেন- চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী।

দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক এই সংসদ সদস্য বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) ভোরের দিকে অবৈধভাবে ভারতে পালানোর চেষ্টাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার গাজীরবাজার থেকে বিজিবির হাতে আটক হন। আটকের পর বিজিবির জিজ্ঞাসাবাদে ফজলে করিম জানান, তিনি চিকিৎসার জন্য অবৈধপথে ভারতে যাচ্ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার ভুল হয়েছে।’ ফজলে করিমকে ভারতে পালাতে সহযোগিতা করার অভিযোগে মো. আব্দুল হান্নান নামে একজন ও পাচারকাজে জড়িত নাঈম চৌধুরী নামে আরো একজনকে আটক করা হয়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে আখাউড়া থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার জাবেদুর রহমান।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৬ আসন (রাউজান) থেকে টানা পঞ্চমবারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ প্রার্থী ফজলে করিম। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর গত ১৯ আগস্ট তার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে একটি মামলা করেন রাউজানের পশ্চিম গুজরা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সিরাজদৌল্লাহ।

দুই বছর আগে অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায় করে অস্ত্র দিয়ে ফাঁসানোর অভিযোগ আনা হয় মামলায়। এছাড়া সাত বছর আগে ফজলে করিমের লোকজনের হাতে কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা নুরুল আলম নুরু খুন হওয়ার ঘটনায় গত ৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের একপি আদালতে ফজলে করিমসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

এদিকে ফজলে করিমকে আটকের খবরে রাউজান এলাকায় অনেকেই মিষ্টি বিতরণ করছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে রাউজান উপজেলার এক বিএনপি নেতা বলেন, ‘অনেক তাজা প্রাণের ঘাতক এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। তিনি তার প্রতিপক্ষ বরদাশত করতেন না। তিনি এমন এক ব্যক্তি যার বিরুদ্ধে আমলনামা দীর্ঘ এবং রক্তাক্ত। গত প্রায় ১০ বছর ধরে গোটা রাউজানে অঞ্চলে তার নামটি ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছিল।’

তাকে আটকের পর কামাল উদ্দিন নামে এক সংবাদকর্মী তার সম্পর্কে ফেসবুকের স্টাটাসে লিখেছেন—‘আমি সেই সময়ই প্রথম কলম ধরেছিলাম তার (ফজলে করিম) বিরুদ্ধে, যখন অনেকেই তার ক্ষমতার ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পেতেন না। তার ছায়ায় ঘটে যাওয়া অপরাধগুলোর মধ্যে নুরুল আলম হত্যা (ছাত্রদল নেতা) কেবল একটি অধ্যায় মাত্র। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন, চাঁদাবাজি, জমি দখলের মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তার নাম জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে ফজলে করিম বারবারই আইনের ফাঁক গলে পালিয়ে যেতে পেরেছেন।’

২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য হন ফজলে করিম। সেই থেকে রাউজানে বিনা ভোটের রেওয়াজ শুরু হয়েছিল।

এলাকাবাসী জানান, ফজলে করিম এতটাই প্রতাপশালী ছিল যে ভোটের জন্য প্রার্থীর পক্ষে মাইকিং, পোস্টার ছাপানো, লিফলেট বিতরণ, পথসভা, গণসংযোগ কিছুর দরকার পড়ত না রাউজানে। বিরোধী প্রার্থীদের প্রচারে বাধা, হুমকি, সংঘর্ষের মতো কোনো ঘটনাও ঘটতো না ওই উপজেলায়।

গত ১০ বছর ধরে রাউজানের ৬ লাখের বেশি মানুষ ভোট দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনের সুযোগই পাননি। স্থানীয় সরকারের প্রতিটি নির্বাচনে ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ ক্ষমতাসীন আওয়ামী প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার রীতি প্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় উপজেলাটিতে। এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বাইরে বিএনপি কিংবা অন্য দল, এমনকি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা ফজলে করিমের একাধিপত্যের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সাহস পেত না।

ফজলে করিম সম্পর্কে রাউজান উরকিরচর এলাকার বাসিন্দা ফারুক হাসান বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে আগস্টের ১ বা ২ তারিখে নোয়াপাড়ার এলাকার এক গৃহবধূ ছাত্রদের পক্ষে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সেদিন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্থানীয় এক চেয়ারম্যানের মাধ্যমে থানায় ধরে নিয়ে ফজলে করিমের নির্দেশে ওই নারীর বিরুদ্ধে বিস্ফোরক আইনে মামলা দেয় পুলিশ।’ 

নাম প্রকাশ না করে স্থানীয় বিএনপির এক নেতা বলেন, ‘রাউজান উপজেলা বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদলের নেতাকর্মী তো দূরের কথা। তার (ফজলে করিম) নিজ দলের নেতা দেবাশীষ পালিত ২০১৮ সালে রাউজান পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরেও এলাকায় গিয়ে অফিস করতে পারেনি। শহরে অফিস ভাড়া নিয়ে মানুষের সেবা করতে বাধ্য হয়েছেন। বিএনপি-জামায়াতের শত শত নেতাকর্মী ১০ বছর ধরে গ্রামের বাড়ি রাউজানে যেতে পারেননি। এখন তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।’

রাউজান হাজিপাড়ার বাসিন্দা আহমদ হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র ফজলে করিমের লোকজনের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ থাকার কারণে মা-বাবার কবর জেয়ারত করতে গেলে ওমানপ্রবাসী মোহাম্মদ মুসা (৪৫) নামে বিএনপির এক কর্মীকে মারধর করে হত্যা করা হয়। মুছার বাড়ি রাউজান পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ডের হাজিপাড়া গ্রামে। কোনো অপরাধ চিরকাল চাপা থাকে না। প্রকৃতিতে বিচার হবেই।’ 

নিহত মুসা ঘটনার দুই মাস আগে দেশে আসেন। তার ১০ বছর এবং ৫ বছর বয়সী দুটি সন্তান রয়েছে। মুসার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে হাটহাজারীর মদনহাট এলাকায় বাবার বাড়ির পাশে একটি ভাড়া বাসায় থাকেন।

-বিজ্ঞাপন-
বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

বিজ্ঞাপন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ প্রতিবেদন