অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির অন্যতম সমন্বয়ক লেখক ও গবেষক সাজ্জাদুর রহমান, যিনি রাখাল রাহা নামেই পরিচিত। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে প্রণীত ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের পাঠ্যবই নিয়ে বিতর্ক দিয়ে সমালোচনার শুরু। ফেসবুকে ‘ধর্ম নিয়ে কটূক্তি’র অভিযোগ ওঠার পর তার পরিসর আরও বাড়ে। তবে সম্প্রতি দুটি অনলাইন গণমাধ্যমে তার বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর তা যে ‘আগুনে ঘি ঢালে’। যদিও ‘এক্সক্লুসিভ’ প্রতিবেদনটি পরে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
নিজেকে নিয়ে চলমান আলোচনা-সমালোচনা বিষয়ে সোমবার (১০ মার্চ) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়েছেন রাখাল রাহা। ‘পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনে যেসব “ইচ্ছেকৃত ভুল” করেছিলাম এবং “যতো টাকা” পেয়েছিলাম!’— শিরোনামের এই লেখায় তিনি প্রশ্নোত্তর আকারে বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সরকারের সঙ্গে যুক্ত সবাই যখন ফেসবুকে এসে কৈফিয়ত দিচ্ছেন, তখন আমি সরকারের কোনও পদ গ্রহণ না করেও যে কিছু কাজ করেছি, তার ভেতরের চিত্র প্রকাশ করা নিশ্চয়ই ভুল বা অন্যায় হবে না।’

রাখাল রাহার জবানবন্দী
কীভাবে পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা কাজের সঙ্গে যুক্ত হলেন, তার ব্যাখ্যায় রাখাল রাহা বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যখন সন্তানের পাশে অভিভাবক সংগঠনের পক্ষ থেকে আহতদের আর্থিক ও মানসিক সাহায্য করার কাজ করছিলাম, তখন আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষের দিকে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ স্যারের একটা মেসেজ পেয়ে আমি তাকে ফোন করলাম। তিনি আমার সরাসরি শিক্ষক, কিন্তু তার সঙ্গে আমার আগে কখনও কথা হয়নি। তিনি আমাকে চিনতেনও না।‘
পরে কীভাবে নতুন কারিকুলাম বাতিল হলো এবং অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ হিসেবে ২০১২-এর কারিকুলামে ফিরে যাওয়া হলো এসবেরও বর্ণনা দেন রাখাল রাহা। তিনি আরও লেখেন, কারিকুলাম তৈরি ও পাঠ্যবই লেখার কাজ কখনও শুরু হয়নি। কারণ আমরা কোনও কারিকুলাম তৈরি করিনি, পাঠ্যবইও লিখিনি। আমরা ২০১২ সালের কারিকুলামে প্রকাশিত বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণ ২০২৩-২৪ সালের বই পরিমার্জনার কাজ করেছি।
এরপর ‘পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কাজ কবে থেকে শুরু হলো এবং কীভাবে শুরু হলো’, ‘বিষয় ভিত্তিক টিম গঠন কীভাবে হলো?’ এসব বিষয়ও বর্ণনা করেন রাখাল রাহা। তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টা স্যারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রফেসর কামরুল হাসান মামুন, প্রফেসর সামিনা লুৎফা ও আমি বিষয়ভিত্তিক পরিমার্জনা টিমের খসড়া তালিকা তৈরি করি। এনসিটিবির বিশেষজ্ঞরাও এতে নানাভাবে মতামত দেন, কে থাকতে পারছেন বা পারছেন না ইত্যাদি জেনে সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে প্রথম ৪১ জনের তালিকা তৈরি করা হয়। এরপর সেটা এনসিটিবির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। প্রথম তালিকাটা মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে দেয়। কিন্তু পরিমার্জনা কাজের ব্যাপ্তি বুঝে বিভিন্ন বিষয় ভিত্তিক টিমের সদস্যরা আরও ১৬ জন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সদস্যদের তালিকাও এনসিটিবির মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় বেশ পরে। কিন্তু ১৬ জনের তালিকা আমাদের কাজ চলাকালে মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেনি।’
পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটিতে দায়িত্ব পালন করলেও নিজের কোনও পদ ছিল না উল্লেখ করে রাখাল রাহা জানান, এ কাজের জন্য এনসিটিবি থেকে এখনও কোনও সম্মানী গ্রহণ করেননি তিনি। এমনকি কাউকেই এখনও কোনও সম্মানী দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে গিয়ে নতুন শিক্ষাবর্ষের বই সামনে আসার পরেই বরাবরের মতো এবারও পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কোনও কমিটি বাতিল করা হয়নি। পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনার কোনও কমিটি ছিল না, শুধু বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের দল ছিল। যেটা বাতিল করা হয়েছে, তা হলো মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে গঠিত পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনা বিষয়ক একটা সমন্বয় কমিটি।
রাখাল রাহা তার লেখায় মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব খ ম কবিরুলের তীব্র সমালোচনা করেন। এমনকি বিভিন্ন পর্যায়ে এই অতিরিক্ত সচিব পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের কাজ বাধাগ্রস্ত করেছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি। খ ম কবিরুল এক পর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের লেখা বইও পাঠ্যক্রমে যুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়েছেন অভিযোগ করে রাখাল রাহা লিখেছেন, ‘খ ম কবিরুল সাহেব তার নতুন লেখা বইগুলো উপদেষ্টা স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু উপদেষ্টা স্যার তাড়াহুড়া করার পক্ষে ছিলেন না। তিনি একটু বিরক্তই হয়েছিলেন বোধহয়। তাই খ ম কবিরুল সাহেব সেপ্টেম্বরের পর আর এ বিষয়ে কথা বলেননি। তবে কমিটিটা যদি ঘটনাচক্রে বাতিল না হতো, তিনি হয়তো তার উদ্যোগ বাস্তবায়নে আরও বহু কিছু করতেন।’
মন্ত্রণালয় থেকে জুলাই অভ্যুত্থান বিষয়ক বিভিন্ন লেখা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ ছিল বলেও জানান রাখাল রাহা। শেষ পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে সেগুলো রাখা হয়েছে কিনা, এর ব্যাখ্যা তিনি লেখেন, ‘সিদ্ধান্ত হলো প্রথমত বাংলা, ইংরেজি, সমাজ ইত্যাদি বইয়ের পেছনে গ্রাফিতি ব্যবহার করা হবে। দ্বিতীয় হলো প্রাথমিকের বাংলাতে শহীদদের নিয়ে ১টা, মাধ্যমিকের বাংলাতে পোস্টার-গ্রাফিতির ভাষা নিয়ে একটা এবং মাধ্যমিকের ইংরেজীতে গ্রাফিতি নিয়ে ১টা টেক্সট তৈরি করা হবে। টেক্সটগুলো এমন হবে যেন, আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ের স্বাভাবিকভাবে প্রতিস্থাপন হয়, অতিরঞ্জন মনে না হয়।’
তিনি লেখেন, ‘এতটা নিকট ইতিহাসের বিষয় সমাজ বইয়ে আনা কীভাবে সম্ভব তা নিয়ে আমাদের মধ্যে নানান মত ছিল। তাছাড়া সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক টিমের সিদ্ধান্ত ছিল ৭১-এর পরের কোনো ইতিহাস থাকবে না। সুতরাং সমাজ বা ইতিহাস বইয়ে জুলাইকে আনা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন খ ম কবিরুল সাহেব শিক্ষা উপদেষ্টাকে পাশ কাটিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সহ নানা স্থানে বলতে লাগলেন এবং সেখান থেকে নানা সুপারিশ আসতে লাগলো।’
মন্ত্রণালয় থেকে বইয়ের অনুমোদন দেওয়ার বৈঠকে খ ম কবিরুল নবম শ্রেণির বাংলা বইয়ে বিভিন্ন ‘হিন্দু লেখকদের নাম’ এবং ‘মাদ্রাসার বইয়ে এসব গল্প-কবিতা’ নিয়েও আপত্তি তুলেছিলেন বলে উল্লেখ করেন রাখাল রাহা। তার প্রচ্ছন্ন হুমকির পরও মন্ত্রণালয়ের কিছু সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণসহ বই অনুমোদন হয়েছিল বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

আর্থিক কোনও কাজে নিজের এবং পরিমার্জন কারও কোনও সংশ্লিষ্টতা ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের পরিমার্জনা দলের কারণে বই প্রকাশের কোনও দেরি হয়নি। যখন যে বইয়ের চুক্তি হবে, সিডি দেওয়া লাগবে; এটা জানার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সেই বই ছেড়ে দিয়েছি। এটা আমরা বলে রেখেছি এবং এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ সেভাবেই আমাদের জানিয়েছে এবং এভাবেই আমরা সকল বই দিয়েছি। কিন্তু এইসব চুক্তি, সিডি তৈরি, মুদ্রণ বা টেন্ডার এগুলো কাজের সঙ্গে আমাদের কোনও সম্পর্ক বা সংযোগ ছিল না। কত কত হাজার কোটি টাকার কাজ হচ্ছে তা আমাদের একেবারেই ভাবনার বিষয় ছিল না।
তিনি বলেন, ‘নভেম্বরের শেষের দিকে আমি উপদেষ্টা স্যারকে বললাম যে, আমার কাজ তো শেষ, আমি ডিসেম্বরের এক তারিখে নিজের কাজে ফিরে যেতে চাই। তিনি বললেন, তুমি আরো কিছুদিন থাকো। কারণ এলোমেলো হতে পারে এবং সত্যিসত্যিই দেখলাম, অনেকগুলো সেনসিটিভ বিষয়ে এলোমেলো হলো, বা করা হলো। নিশ্চিত যে আমি না থাকলে সেগুলো নিয়ে ভয়ঙ্কররকম বিতর্ক হতে পারতো, এমনকি বই বাতিল করতেও হতে পারতো।’
সেসময় কিছু এলোমেলো পোর্টালে রাখাল রাহা ও পরিমার্জন টিমের কাজ নিয়ে ‘কিছু তথ্য, কিছু অর্ধসত্য আর কিছু মিথ্যা মিশিয়ে’ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট প্রচার হতে লাগলো বলে অভিযোগ করেন তিনি। বলেন, ‘এনসিটিবির মধ্যকার কাজ না জানা দুয়েকটা গরু-গাধাও তাদের সঙ্গে যোগ দিলো। দেশে-বিদেশে কিছু মানুষ ফেসবুক-ইউটিউবে আন্দাজে কথা বলতে লাগলো। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল এগুলো পোর্টাল-চ্যানেল-সেলিব্রেটিরা যেহেতু ভিউ বিজনেস করে, মানুষ এগুলো ততোটা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম বিপুল সংখ্যক মানুষ, যারা আমাকে চেনে না জানে না, তারা বিশ্বাস করছে। এমনকি, তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে এমন অনেকে যাদের সঙ্গে একত্রে রাজপথেই ছিলাম শুধু না, তাদের অনেকের বিপদে সর্বোচ্চ করার চেষ্টা করেছি, জেলখানায় গিয়ে খাবার-টাকা পৌঁছে দিয়েছি পর্যন্ত।’
‘সবাই তবে মিথ্যে, আমিই সত্যি?’ এমন প্রশ্ন করে উত্তরে রাখাল রাহা বলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর নেই বাংলাদেশে। কারণ দীর্ঘ দুঃশাসন, কুশিক্ষা আর প্রতারণায় এদেশে মানুষ আজ এমন অবস্থায় আছে যে, বিশ্বাস করতে পারে না এমন কিছু নেই এবং একইসঙ্গে অবিশ্বাস করতে পারে না এমন কেউ নেই। না হলে আমাকে নয়, যারা এলোমেলো বলছেন-লিখছেন; একজন ব্যক্তির জীবনকে চরম ঝুঁকিপূর্ণ করছেন, তাদেরই সবার আগে জিজ্ঞাসা করার কথা যে, তুমি কিসের ভিত্তিতে এটা বলছো বা লিখছো? জবাবদিহি যে চাইছে, তার তথ্যই যদি ভুল হয়, উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়, তবে তো তাকেই সবার আগে জবাবদিহির মুখে ফেলার কথা।’
নিজের ভবিষ্যত তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার কোনও পাসপোর্ট নেই, ছিলও না কখনও। পাসপোর্ট পকেটে রেখে আমি চলিনি, চলবো না। কারণ দেশটা আমার বাপেরও।’