রাজধানীর সড়কগুলো যেন মগের মল্লুক। কিসের ট্রাফিক আইন? আর কিসের সিগন্যাল? সড়কে সবাই যেন রাজা। কারণ ট্রাফিক আইন থাকলেও সেটি তোয়াক্কা করছেন না অধিকাংশ চালক-আরোহী; এমনকি পথচারীরাও। বেশির ভাগ সড়কের মোড়ে সিগন্যাল ব্যবস্থা ধরে রাখতে হচ্ছে লাঠি-বাঁশি কিংবা হাত উঁচিয়ে। কোথাও আবার সিগন্যাল কার্যকর করতে সড়কের মুখে দড়ি বা রশি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে রাখতে হচ্ছে। সেখানেও পারলে সেই ব্যারিকেড ভেঙে ছুটে চলতে চান একশ্রেণির চালক। সিগন্যালে একটু অপেক্ষা করতে হলেই ক্ষুব্ধ হচ্ছেন তারা। বাগবিতণ্ডা হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে।

অন্যদিকে বিজয় সরণির মোড়, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও শাহবাগসহ প্রায় সব কটি ভিআইপি রোডের গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পথচারীরা কোনো নিয়মনীতির ধার ধারছেন না। রাস্তার চতুর্দিক থেকে তারা ছোটাছুটি করে রাস্তা পার হচ্ছেন। পুলিশ, ট্রাফিক, দায়িত্ব পালনরত ছাত্র কারও কথার তোয়াক্কা করছেন না তারা। ফলে কোনো যানবাহন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারছে না। এর ফলে প্রচণ্ড জট লেগে যাচ্ছে এসব সড়কে।
গত এক সপ্তাহে রাজধানীর অন্তত ২০টি পয়েন্টে অবস্থান করে দেখা গেছে- অধিকাংশ সড়কে ট্রাফিক আইন ভাঙার প্রবণতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে প্রধান সড়কে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেলের দৌরাত্ম্য এখন ট্রাফিকের সব যেন আইন বা শৃঙ্খলার ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। গাড়িচালক, রিকশাচালক, পথচারী- প্রায় সবাইকেই ট্রাফিক আইন বা নিয়ম ভেঙে চলতে দেখা গেছে। ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা পারাপার, বেপরোয়া গতিতে চলাচল, সংকেত (ইন্ডিকেটর) না দিয়ে লেন পরিবর্তন, অহেতুক হর্ন বাজানো, যত্রতত্র রাস্তায় যানবাহন দাঁড়ানো, সড়কের মাঝে গণপরিবহনে যাত্রী তোলা-নামানো, আঁকা-বাঁকাভাবে বা বিশৃঙ্খলভাবে সড়কে গণপরিবহন দাঁড়ানো, ফুটওভার ব্রিজ ও ফুটপাত ব্যবহারে পথচারীদের অনীহা, উল্টোপথে গাড়ি চলাচলসহ অসংখ্য বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে।

রাজধানীর সড়কে নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা
বিজয় সরণিতে ঝুঁকিপূর্ণ পারপার
গত শনিবার দুপুর ৩টায় রাজধানীর বিজয় সরণি সিগন্যালে অবস্থানকালে দেখা যায়, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ যানবাহনের ভিড়ে একজন ব্যক্তি তার দুই সন্তান ও স্ত্রীসহ ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তখনো কোনো সিগন্যাল পড়েনি। তাদের পাশ দিয়েই দ্রুতগতিতে দুটি মোটরসাইকেল চলে যায়। পেছনে সারি সারি গাড়ি হর্ন দিচ্ছিল, আর থেমে থেমে চলছিল। পেছন দিয়ে দ্রুতগতিতে অটোরিকশা যাচ্ছিল। এতে তিনি দু-একবার আতঙ্কে থমকে দাঁড়ান। পরে হাতের ইশারা দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে সড়কটি পার হন।
এ সময় বিজয় সরণি ট্রাফিক পুলিশ বক্সের সার্জেন্ট কাজল কুমার বিশ্বাস, ‘সবার প্রথমে নিজেদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নিজেদের মধ্যে সচেতনতা না এলে ট্রাফিক আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকরী ফলাফল আসবে না। সবাই যদি সচেতন হন, দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে।’
কারওয়ান বাজার-গ্রিন রোড সিগন্যালে বাইক ও রিকশার ভোঁ দৌড়
গত শনিবার দুপুরে রাজধানীর অন্যতম প্রধান ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা মোড়ে রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন ও পথচারীদের ব্যাপক বিশৃঙ্খলভাবে চলাচল করতে দেখা যায়। এখানে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা একদিকে আটকালে আরেক দিক দিয়ে সবাই নিয়ম ভেঙে চলতে থাকে। দুপুর আনুমানিক ১টার দিকে কারওয়ান বাজারের অদূরে গ্রিন রোড সিগন্যালেও দেখা যায় প্রায় অভিন্ন চিত্র। এখানে মোড়ের চারদিকেই তখন যানবাহনের বেশ চাপ। এ সময় কারওয়ান বাজারের দিক থেকে পান্থপথমুখী অংশে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল (অনুপ) শৃঙ্খলা রক্ষায় মোড়ের আরও কিছুটা আগেই গাড়ি থামিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সামনের দিকে থাকা কিছু মোটরসাইকেল এবং ব্যাটারিচালিত রিকশার যেন তর সইছিল না। চাকা ঘুরিয়ে একটু একটু করে একপর্যায়ে মোড়ের একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাইক ও রিকশাগুলো। এর মাঝে ওই কনস্টেবল হাত উঠিয়ে তাদের আর না এগোতে নিষেধ করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! উল্টো দিকের অন্য একটি সিগন্যাল ছেড়ে দিতেই সামনে থাকা দুটি বাইক ও একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা ভোঁ দৌড় দিয়ে ছুটতে থাকে। ঠিক এমন সময় পেছনের দিক থেকে আরেকটি বাইক এগোনোর চেষ্টা করলে ওই মোটরসাইকেলকে (ঢাকা মেট্রো হ ৫৯-৫৩৪০) সামনে থেকে হাত দিয়ে জোর করে আটকে রাখেন ট্রাফিক কনস্টেবল অনুপ। এই নিয়ে ওই বাইকচালক ও আরোহীর সঙ্গে দায়িত্বরত ওই পুলিশ সদস্যের খানিকটা বাগবিতন্ডাও হয়। এ সময় কয়েকটি মোটরসাইকেল ও রিকশা সিগন্যাল অমান্য করে মোড় পার হয়ে চলে যায়।
উত্তরায় যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার দাপট
শনিবার দুপুর সোয়া ১টায় উত্তরা হাউস বিল্ডিং সিগন্যালে চারদিক থেকেই যানবাহন ও পথচারীর চাপ দেখা যায়। আব্দুল্লাহপুর থেকে মহাখালীগামী সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল পরিস্থান পরিবহন ও রাইদা পরিবহনের দুটি বাস। এতে পেছনে থাকা গাড়িগুলো আটকে যানজটে পড়েছিল। তার মাঝে ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো সড়কে অর্ধেক অংশ দখল করে এলোপাতাড়ি ছুটছিল। পাশে সড়কের খানিকটা দখলে রেখেছিল রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলগুলো। এলোমেলোভাবে পার হচ্ছিলেন পথচারীরা।
ওই দিন দুপুরে টঙ্গী-উত্তরা ফ্লাইওভার থেকে যানবাহনগুলো নেমে এই সিগন্যালে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল। কারণ সামনের দিকে নানা ধরনের যানবাহনের জটলা। সড়কে চলন্ত বাস থামিয়েও পথচারীরা দৌড়ে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। যদিও সেখানে ফুটওভার ব্রিজ ছিল, তবুও পথচারীদের সেটিতে উঠতে অনীহা দেখা গেছে। মূল সড়ক থেকে উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের শাহজালাল অ্যাভিনিউ সড়কের প্রায় পুরোটি ব্যাটারিচালিত রিকশার দখলে ছিল। আজমপুর থেকে একটু সামনে এগিয়ে গেলে জসীমউদ্দীন মোড়। সেখানেও রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইকের বেপরোয়া চলাচল দেখা যায়। উত্তরা থেকে বিমানবন্দন সিগন্যাল পর্যন্ত দেখা যায় প্রায় অভিন্ন চিত্র।
এ সময় আজমপুর ট্রাফিক বক্সের দায়িত্বরত সার্জেন্ট এস এম নকীব হোসেন বলেন, ‘সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির মূলে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এরা কোনো আইন মানতে চায় না। প্রতিদিন অনিয়মের কারণে এই বাহনটি ডাম্পিং করা হচ্ছে, তার পরও শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না।’
মিরপুরের সড়কগুলোতে উল্টোপথে চলাচল
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মিরপুর-১২ নম্বর (পল্লবী) মোড় থেকে মিরপুর-১১ নম্বর হয়ে সোজা ১০ নম্বর গোল চত্বর পর্যন্ত পুরো সড়কেই ব্যাটারিচালিত রিকশা বেপরোয়া চলাচল করছে। এই সড়কের উভয় পাশে উল্টোপথেও চলছিল রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। সড়কের মোড়ে মোড়ে জটলা করে যাত্রীর জন্য অপেক্ষমাণ থাকতে দেখা যায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের। এই সড়কে গণপরিবহনগুলোও কাউন্টার ছাড়াই যত্রতত্র যাত্রী ওঠাচ্ছিল ও নামাচ্ছিল। এ ছাড়া মোটরসাইকেলচালকরাও যে যার মতো সড়কে চলাচল করছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিরপুর-১০ নম্বর ট্রাফিক পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত সার্জেন্ট আনিচুর রহমান বলেন, ‘প্রতিদিনই ব্যাটারিচালিত রিকশা ধরে ডাম্পিং করছি। এ ছাড়া বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে যানবাহন ও চালকদের বিরুদ্ধে মামলা দিচ্ছি। সবাই কমবেশি আইন মানছেন, কিন্তু ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা বেপরোয়া চলাচল করছেন।’
ফার্মগেটে রাস্তা-ফুটপাত যানবাহনের দখলে
রাজধানীর শ্যামলীর শিশুমেলা, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ ও ফার্মগেট-খামারবাড়ি মোড়েও ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উল্টোপথে চলছিল রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা, পথচারীসহ প্রায় সবাই। কয়েকটি পয়েন্টে দেখা গেছে, পথচারী পারপারের ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন। এসব এলাকার সড়কগুলোর ফুটপাতজুড়ে দোকান বসতে দেখা যায়। ফার্মগেটে মোড়ের আগে রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে জটলা করে রাখা হয় লেগুনা, ভ্যান, রিকশাসহ বিভিন্ন যানবাহন। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে ফার্মগেট-খামারবাড়ি পর্যন্ত সড়কজুড়ে ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশার বেশ চলাচল। যার বেশির ভাগ আবার উল্টোপথেই চলছিল। মূল সড়কে বাস, প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদেরও অনেকটা যেন নির্বিকারভাবে সিগন্যাল নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায় এসব পয়েন্টে।
শ্যামলীর শিশুমেলার সামনে সড়কে পথচারীরা নেমেই ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও শিশুমেলার মুখে বিড়ম্বনায় পড়েন। শাওন নামে এক পথচারী বলেন, ফুটপাতজুড়ে দোকান আর রাস্তার অর্ধেকটা জুড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা। হাঁটার জায়গা নেই। পুলিশের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও লেগুনার দৌরাত্ম্য বন্ধে সরকারের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।
ট্রাফিক পুলিশ বিভাগ কী বলছে
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার বলেন, ‘ইতোমধ্যে মিরপুরে পথচারীদের জন্য সিগন্যাল বাতি ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের সহায়তা পেলে এসব সিগন্যাল বাতি পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সব পয়েন্টে বসানো হবে। এ ছাড়া রাইড শেয়ারিং বাইকারদের বিশৃঙ্খলা ও ব্যাটারিচালিত রিকশার বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে। ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো মূল সড়কে চলাচলের জন্য চালক ও যাত্রী উভয়ের সমান দোষ। এ ছাড়া পথচারীদের জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারের প্রবণতা খুব কম। এ জন্য ডিএমপি ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে।’
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অভিযান
গত ১ এপ্রিল থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত ২৪ দিনে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে রাজধানীতে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চালিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। এই সময়ে মোট ২৫ হাজার ৩০৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিন হাজার ১০১টি গাড়ি ডাম্পিং ও ১ হাজার ৩২৭টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। এসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার ৫৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ১২৯টি গাড়ি ডাম্পিং এবং ৫৫টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে।
দেখুন: বিনা বেতনের ‘ট্রাফিক পুলিশ’