রাশিয়ায় গিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন রাজবাড়ী সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭)।নজরুলের পরিবারে সেটা জেনেছেন ৫ মাস পর।তবে পরিবারের দাবী সরকারের মাধ্যমে যেন তারা লাশ ফেরত পান।দীর্ঘ সাত মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে গত বুধবার (৮ অক্টোবর) বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয় পরিবারকে।খবরটি পেয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো পরিবার।
নজরুল ইসলাম রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে। নিহত নজরুলের চার কন্যাসন্তান আছে। তার বড় মেয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।দ্বিতীয় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে।ছোট দুই মেয়ের বয়স ৬ ও ৫ বছর।
পরিবারের সদস্যরা জানান, নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান। এর আগে ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে কঙ্গো গিয়েছিলেন। চাকরি থেকে অবসরের পর বাড়িতে থাকতেন। কিছু দিন পর রাজবাড়ীর শ্রীপুর বাজারে মুদি ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ব্যবসায় বড় লোকসান হওয়ায় আর্থিক সংকটে পড়েন। এই অবস্থায় স্থানীয় এক দালাল ফরিদ হোসেন তাকে রাশিয়ায় শপিং মলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির লোভ দেখায়।
বিষয়টি স্ত্রী আইরিন আক্তার জানার পর নানা উপায়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন নজরুলকে। কিন্তু নজরুল বলেন, রাশিয়ায় ভালো বেতন দেবে, সংসারের অবস্থা ভালো হবে।এরপর ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। সেখানে পৌঁছানোর পর এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে তাকে বাধ্য করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় তাকে।
তখন নিয়মিত পরিবারের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো নজরুল। স্ত্রীকে নজরুল বলতো এখান থেকে ফিরে আসার আমার কোন উপায় নেই। আমার ফোন বন্ধ পেলে ভাববা মারা গেছি।পরিবারের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয় ৩০ এপ্রিল। সেইদিন নজরুল তার স্ত্রীকে জানান—তিনি ব্যাংকে যাচ্ছেন টাকা পাঠাতে। কিছুক্ষণ পর ফের ফোন করে বলেন, টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ পাও
নিহতের স্ত্রী আইরিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী অবসরের পর বাড়িতে থাকতো। ব্যবসায় লোকসান হওয়ায় ফরিদ দালালের মাধ্যমে রাশিয়ায় যায়। আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, সন্তানদের নিয়ে আমরা একসাথে থাকব। কিন্তু সে বলল, রাশিয়ায় ভালো চাকরি আছে, নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ। আমি চার মেয়েকে নিয়ে কিভাবে বাঁচব?” আমার এখন একটাই চাওয়া আমার স্বামীকে অন্তত আমার কাছে এনে দিক সরকার। শেষবার আমি একটু আমার স্বামীকে দেখতে চাই।
নজরুল ইসলামের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম বলেন, ফরিদ নামের দালাল আমার ভাইকে প্রলুব্ধ করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। আমরা বহু জায়গায় খোঁজ নিয়েছি। ফরিদ সব সময় বলত, ও বেঁচে আছে, নেটওয়ার্ক না থাকায় যোগাযোগ করতে পারছে না। এখন শুনলাম ও আর বেঁচে নেই। সরকার যেন অন্তত লাশটা দেশে আনার ব্যবস্থা করে।
অভিযুক্ত দালাল ফরিদের সঙ্গে ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি রাশিয়া পাঠাইনি নজরুলকে। সে গেছে বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এজেন্সির মাধ্যমে। আমি শুধু যোগাযোগ করে দিয়েছি। সে সব জেনে-শুনেই গেছে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে। নো অবজেকশন সার্টিফিকেটে স্বাক্ষরও করে গেছে। আমি গত রাতে শুনেছি, মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে নজরুল মারা গেছেন।
এ বিষয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারিয়া হক বলেন, বিষয়টি আমি সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জেনেছি। অফিসিয়ালি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের জানানো হয়নি। এ বিষয়ে কোন চিঠিও আমাদের কাছে আসেনি। তারপরও বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি এবং নজরুলের পরিবারের সাথে কথা বলছি বলেছি।
পড়ুন : রাজবাড়ীতে টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন উপলক্ষে কর্মকর্তাদের সাথে পরামর্শ কর্মশালা


