বরিশাল নগরীর দপদপিয়া ব্রিজের কিছুদূর সামনে গেলেই একটি গলির মুখে চোখে পড়ে আলিশান নান্দনিক ডিজাইনের কারুকাজ খচিত একটি সুবিশাল গেইট। পাশ দিয়ে গেইটের ভিতরে তাকাতেই দেখা যায় বিশাল এক জমির মাঝে আলিশান এক বাংলো বাড়ি। সেই বিশাল সীমানা প্রাচীরের গেট আটকে ভিতরে চলছে বাংলো বাড়ির জন্য আলাদা এক প্রাচীর নির্মাণের কাজ। সেখানে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। সে সময় রাস্তা দিয়ে চলাচলরত লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায় বাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস-১) মোঃ খাইরুল ইসলামের।
জানা গেছে, নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ড গ্যাস্টারবাইন এলাকায় মেইন রোডের পাশেই পুরো ৫ একর জমির ওপর বিশাল সুউচ্চ সীমানা প্রাচীর দিয়ে একটি বহুতল বাংলো বাড়ি নির্মাণ করেছেন খাইরুল ইসলাম। মাঝে মাঝে বরিশালের এই বাংলো বাড়িতে আসতেন তিনি। বাড়ির ভিতরে করেছেন বিশাল এক গরুর ফার্ম। যে সব দেখাশোনা করার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা লোক। আবার নিজের বাংলো বাড়ির পাশে সরকারি খাল দখল করে গড়ে তুলেছেন বসতি। যেখানে বসবাস করেন তার বরিশালের সম্পদ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ম্যানেজার মামুন। সেই খালের বিপরীত পাশে প্রায় এক একর জমিতে বাউন্ডারি দিয়ে করেছেন মার্কেট। যার নাম দেয়া হয়েছে পিএস মার্কেট।

ঐ এলাকার স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, এমন একরে একরে সম্পদ ও ঘরবাড়ি শুধু বরিশালে নয় দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা উপজেলায় খাইরুল ইসলামের নামে বেনামে জমি ও বাড়ি রয়েছে।
গ্যাস্টারবাইন এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রাকিবুল আলম বলেন, এখান থেকে যতদূর চোখ যায় সব জমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিএস খাইরুল ইসলামের। তিনি প্রতি বছরের ৫ ডিসেম্বর এখানে ৫ হাজার লোকের সমাগম ঘটিয়ে বিশাল মাহফিলের আয়োজন করেন। মাহফিলে আগতদের জন্য প্রায় ২৫/৩০টি গরু জবাই করে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে এতো সম্পদ কিভাবে করেছেন তা জনগণের বুঝতে বাকি নেই।

পিএস মার্কেটের এক দোকানি আসলাম বলেন, এই মার্কেটে ৯টি দোকান রয়েছে। দোকান প্রতি ভাড়া আড়াই হাজার টাকা করে। প্রতি মাসের শেষে খাইরুল ইসলামের ম্যানেজার মামুন এসে ভাড়া উত্তোলন করে নিয়ে যায়।
এসব বিষয়ে নিয়ে কথা হলে খাইরুল ইসলামের ম্যানেজার মামুন বলেন, ‘ভাই আমি চাকরি করি, তাই নির্দেশনা অনুযায়ী সব করি। আমার দায়িত্ব এই সব বাড়িঘর দেখে শুনে রাখা, ভাড়া তোলা। সে অনুযায়ী টাকা তুলে পাঠিয়ে দেই। এছাড়া স্যারের সাথে যোগাযোগ হয় না, যখন প্রয়োজন হয় স্যার নিজেই একেক নম্বর দিয়ে ফোন দেয়। তাছাড়া শুধু এখানেই নয় বিভিন্ন এলাকায় স্যারের এমন জমি ও বাড়ঘর রয়েছে।’

জানা গেছে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সরকারের সিনিয়র সহকারী সচিব ছিলেন মোঃ খাইরুল ইসলাম। শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পান তিনি। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি এই কর্মকর্তাকে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির কাছাকাছি থাকার সুবাদে প্রায় সাড়ে তিন বছরে হয়েছেন বিপুল অর্থবিত্তের মালিক। চাকরিতে পেয়েছেন নজিরবিহীন পদোন্নতি। সব শেষ গত বছরের ২ জুলাই সচিব হিসেবে অবসরে যান। তবে চাকরিকালীন সময় ও শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব থাকাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি ও বাড়ি করেছেন তিনি। এর মধ্যে ঢাকার উত্তরায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ৫ কাঠা আয়তনের একটি প্লটে সাততলা বাড়ি, তথ্য গোপন করে একই প্রকল্প থেকে দ্বিতীয় স্ত্রীর নামেও একটি প্লট বাগিয়ে নেন। সেখানেও একটি ভবন করেছেন। মোহাম্মদপুরে বীর উত্তম নুরুজ্জামান রোডের কসমোপলিটন ভবনে ৪ হাজার বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেসে এস এম ট্রাভেলস এবং মেঘমালা কনস্ট্রাকশন নামের দুটি প্রতিষ্ঠান, ধানমন্ডি শেখ জামাল মাঠসংলগ্ন ‘কসবা’ ভবনে ২ হাজার ৮০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, সায়েন্স ল্যাব-সংলগ্ন কলেজ স্ট্রিট রোডে একটি ১০ তলা ভবনে ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের দুটি ফ্ল্যাটের মালিক সাবেক এই আমলা। এ ছাড়া কুয়াকাটায় মহিপুর মৌজায় ১৫ একর জমি, বরগুনার আমতলীতে মেঘমালা ফিলিং স্টেশন নামে একটি পেট্রলপাম্পও আছে এই আমলার।
জানা গেছে, খাইরুল ইসলামের প্রথম স্ত্রীর বড় মেয়ে মেঘমালা এবং ছেলে সৌরদ্বীপ যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন। সেখানে মেয়ে মেঘমালার নামে দুটি বাড়ি কিনেছেন খাইরুল। আর দ্বিতীয় স্ত্রী ইসরাত জাহানকে বছর পাঁচেক আগে তুরস্কে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। তুরস্কের বিধিবিধান মেনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে ইসরাত নাগরিকত্ব নিয়েছেন বলে জানা গেছে।

এসব বিষয়ে কথা বলতে সাবেক সচিব খাইরুল ইসলামের ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে শুধু এমপি মন্ত্রীরাই নয় সর্বস্তরের আমলারা এভাবে বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। এগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যাচাই-বাছাই করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যাতে সামনে আর কেউ এভাবে দেশটাকে লুটেপুটে না খায়।
এনএ/