
পূজার ছুটিতে কুয়াকাটা বেড়াতে গিয়েছিলাম। ভাল লেগেছে। কুয়াকাটার লোকজন পর্যটকদেরকে এখনো টাকার বস্তা ভাবতে শুরু করেনি, আমার মতো লোকজনদের জন্য ব্যাপারটা স্বস্তির। ভ্রমণকাহিনী লিখতে বসিনি। সাগরতীরে ঘোরার সময় যা দেখলাম, কয়েকটি ছবি তুলে এনেছি সবাইকে দেখানোর জন্য।

বইপত্র পড়ে টিভিতে দেখে ডলফিন চিনি ছোটবেলা থেকেই। বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, মানুষের পর ডলফিনই পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। এরা মানুষের কাছে থাকতে পছন্দ করে। বাচ্চাদের সঙ্গে এরা বেশি ঘনিষ্ঠ আচরণ করে। এরা অনুকরণপ্রিয়, বিভিন্ন আকার-ইঙ্গিত বুঝতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি তথ্য অনেক জায়গাতেই আছে।
কিন্তু ইরাবতীর সঙ্গে আমার পরিচয় অল্পদিনের। বেশ কয়েক বছর আগে সুন্দরবনের ভেতরে তেলবাহী, কয়লাবাহী, সারবাহী জলযান একের পর এক ডুবে যখন পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছিল তখন জানতে পারলাম ওদের দুর্দশার কথা। ডলফিনই দেখতে অনেক সুন্দর, কিন্তু ইরাবতী একটু বেশি সুন্দর লাগে আমার কাছে। চেহারাটা কেমন যেন শিশুর মতো। কিন্তু এত সুন্দর প্রাণীটাকে চোখ গলা, পেট ফেটে অন্ত্র বের হওয়া অবস্থায় সাগরের বেলাভূমিতে নিথর পড়ে থাকতে দেখাটা আমার জন্য মন খারাপ করা অভিজ্ঞতা।

ছবির ক্যাপশনে বর্ণিত স্থানের বাইরেও লেবুর চরে যাওয়ার পথে সাগরতীরে আরেকটি ইরাবতীর মৃতদেহ দেখতে পাই। সেটা অনেক বেশি বিকৃত বলে ছবি তুলিনি।
লেখাটি লিখব বলে ইরাবতী সম্পর্কে ইন্টারনেটে পড়তে বসে গেলাম। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া ধাঙমারী, চান্দপাই ও দুধমুখী নদী ইরাবতী ডলফিনের (Orcaella brevirostris) জন্য অভয়স্থল ঘোষিত হয়েছিল ২০১১ সালেই। ওদের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্যই বনবিভাগ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ ওই এলাকায় পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইরাবতী ডলফিনের বাস। সমুদ্র উপকূলের কাছাকাছি, নদীর সাথে সংযোগস্থলে স্বাদু ও নোনা পানির মিশ্রণ আছে এমন এলাকায় এরা বসবাস করে। কুয়াকাটার সাগরের পানিতে লবণ নেই বললেই চলে। তাই সেখানেই সাগরতীরে ওদের দেখা পেয়েছি, তবে মৃত।




বর্তমানে পৃথিবীতে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা আনুমানিক ৭০০০ এর বেশি যার শতকরা ৯০ ভাগই বাংলাদেশে বসবাস করে। বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে লাওস, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, ফিলিপাইন এবং থাইল্যান্ডে প্রাণীটি মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের তফসিল-১ অনুযায়ী এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। আইইউসিএন-এর রেডলিস্টে সুন্দর এই প্রানীটিকে অরক্ষিত দেখানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে এদের সংখ্যা কমছে।
একটি সুস্থ ইরাবতী ডলফিনের উপস্থিতি বলে দেয় যে সাগরের পরিবেশও সুস্থ আছে। নিজেদের পরিবেশ-প্রতিবেশে এদের প্রাকৃতিক শত্রু তেমন কেউ নেই। তারপরও এদের সংখ্যা কমছে। কারণ মানুষের পর পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীটি শত্রু হিসেবে পেয়েছে মানুষকেই।
২০১১ সালে সুন্দরবনের ধাঙমারী, চান্দপাই ও দুধমুখী নদী ইরাবতী ডলফিনের অভয়স্থল ঘোষণা করে সেখানে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ফার্নেস তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবে যাওয়ার পর সেখানে ইরাবতী ডলফিনের বাস অসম্ভব হবে বলে বিশেষজ্ঞরা সেই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন।
আমি তিনটি ইরাবতী ডলফিনের মৃতদেহ দেখতে পেলাম শ্যালা নদী থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে, শ্যালা নদীর দুর্ঘটনার প্রায় তিন বছর পর! মজা করে লিখলাম। ডলফিনগুলোর মৃত্যুর কারণ আছে এই কুয়াকাটাতেই। কিন্তু এই এলাকায় তো কোনো রাসায়নিকবাহী জলযান ডুবে গেছে এমন খবর কখনো পাইনি।
আসল খবরটা পেলাম স্থানীয় ট্যুরিস্ট গাইডের কাছ থেকে। তিনি জানালেন, গত সাত-আট বছর ধরে তারা এমন দৃশ্য দেখে আসছেন। কোনো কোনো দিনে তারা পাঁচ-ছয়টি ইরাবতীর মৃতদেহও নাকি দেখে থাকেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, সাগরে ইলিশ, চিংড়ি ও এরকম অর্থকরী মাছ ধরার সময় জেলেদের জালে যদি ইরাবতীরা আটকে যায় তাহলে ওরা যেন ঝাপটাঝাপটি করে জাল ছিঁড়ে ফেলতে না পারে সেজন্য জেলেরা বৈঠা-লাঠি দিয়ে ওদেরকে পিটিয়ে দুর্বল করে ফেলে, মেরে ফেলে। মৃতদেহ ভেসে আসে সাগরতীরে, পরিনত হয় শেয়াল-কুকুরের খাদ্যে। হ্যাঁ, সাগরতীরের ঝাউবনে শেয়াল দেখেছি, বড় আর সুন্দর দেখতে। আর কুকুর তো আছেই।
ইন্টারনেট থেকে জানতে পারলাম, গিলনেট নামের একটি লম্বালম্বি বিস্তৃত বিশাল জালে আটকে মারা যাওয়া ইরাবতী ডলফিনের আরেক ঝুঁকি।

ইউএনইপি-সিএমএস-এর স্বাদুপানির ইরাবতী ডলফিন সংরক্ষণ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে ইরাবতী ডলফিন যেন বাইক্যাচ অর্থাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবে জেলের জালে আটকে না যায় সেজন্য কর্মপরিকল্পনায় কিছু কৌশলের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যেগুলোর মধ্যে আছে:
এমন মুখ্য সংরক্ষণ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে গিলনেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ অথবা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত।
জাল ব্যবহারের সংখ্যা সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন এবং ফেঁসে যাওয়া ডলফিন নিরাপদে মুক্ত করার ট্রেনিং দেয়া।
জালে ফেঁসে যাওয়া ডলফিন নিরাপদে মুক্ত করতে জেলেদের যে ক্ষতি হয় তা পূরণ করতে প্রকল্প প্রণয়ন।
গিলনেট ব্যবহারকারী জেলেদের জন্য বিকল্প বা বহুমুখী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
মাছ ধরার জন্য ফি নির্ধারণ বা বৃদ্ধির মাধ্যমে গিলনেট ব্যবহার করা ব্যয়বহুল করা এবং নিরাপদ গিয়ার ব্যবহারের জন্য ফি কমিয়ে ডলফিনের ক্ষতি করে না এমন নিরাপদ গিয়ার ব্যবহারে উৎসাহিত করা।
শব্দ প্রতিবন্ধক বা প্রতিক্ষেপক জাল বিষয়ে গবেষণা করা।
এই গিলনেটও পাতা হয় কুয়াকাটার সাগরসৈকতে। সাগরে গোসল করার সময় আমার পা আটকেছিল এতে। এর সম্পর্কে আগে জানতাম না তাই ছবি তুলিনি। কিন্তু আমার বন্ধুর তোলা ছবিতে এই জিনিস ঠিকই ধরা পড়েছে।

বঙ্গোপসাগরজুড়ে জেলেদের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করতে বলছি না আমি। ভারতে, মিয়ানমারে পেশাদার জেলেদের মাছ ধরতে ইরাবতী ডলফিন সাহায্য করে বলে জানতে পারলাম। সেখানে তারা মাছ তাড়িয়ে জেলেদের জালে তুলে দেয়। আমাদের জেলেদের সঙ্গে ইরাবতীদের এমন সম্পর্ক হল না কেন? গিলনেটের ব্যবহার নিষিদ্ধ অথবা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না? জালে আটকে গেলে না মেরে ফেলে ইরাবতীদের মুক্ত করে দেয়ার প্রশিক্ষণ আমাদের জেলেদেরকে দেয়া যায় কি না? ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও মেকং নদীসংলগ্ন দেশগুলো সুন্দর এই প্রাণীটিকে ব্যবহার করে তাদের ইকোট্যুরিজমকে শক্তিশালী করতে পারলে আমরা কেন সেটা করতে পারছি না? কেন আমরা শুধু ইলিশ আর চিংড়ি লোভে এই প্রাণীটিকে নির্দয়ভাবে মেরে ফেলছি? আর কোথায় যাবে ওরা? আমাদের সব চিন্তাই কেন পেট আর পকেটকে ঘিরে?
পরিবেশে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা ঠিক বেঠিক যা খুশি ভাবতে পারি। আমরা ভাবতেই পারি এই পরিবেশে আমরা রাজা, বাকিরা আছে আমাদের সেবার জন্য। আবার এও ভাবতে পারি যে আমরা এই পরিবেশে অন্য জীবদের মতোই একটি অংশ মাত্র। কিন্তু আর সব জীবের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের যে জাল সেই জালে যদি একটি সুতাও ছিঁড়ে যায় তাহলে একসময় পুরো জালটিই শেষ হয়ে যায়। আবার রাজার মতো পা ভাঁজ করে সিংহাসনে বসে সিংহাসনেরই পা ভাঙাটা বুদ্ধির পরিচয় না। ইরাবতীরা বঙ্গোপসাগর থেকে হারিয়ে গেলে ওদের খাদ্য যেসব মাছ আর স্কুইডের মতো সেফালোপোড, সেগুলোর সংখ্যাই বাড়তে থাকবে। জাল ফেললে তখন চিংড়ির চেয়ে ওইসবই ওঠার সম্ভাবনাই বেশি। ইকোসিস্টেম এভাবেই কাজ করে। ইকোসিস্টেম না জানা থাকলে নিজের স্বার্থেই দ্রুত জেনে নিন। কারণ একবার পরিবেশের সর্বনাশটা করে ফেললে আর লাভ হবে না।
মাহমুদুল হাসান ধ্রুব
গণমাধ্যমকর্মী
