
বর্ষপরিক্রমায় আবারও আমাদের দুয়ারে উপস্থিত শ্রেষ্ঠতম আরবি মাস রমজান। অনেক ফযিলতের মাস রমজান আমাদের মাঝে এসেছে তাক্বওয়া, আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম এবং মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আত্মসমর্পণের পুষ্পশুভ্র ও ইস্পাতদৃঢ় চেতনা নিয়ে। নানা কারণে ও তাৎপর্যে এ মাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয়। পবিত্র কুরআন নাযিল হওয়াও এর অন্যতম কারণ।
রমজান রোযার মাস, পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস, লাইলাতুল কদরের মাস, বদর যুদ্ধের মাস, তারাবীহ, কুরআন তিলাওয়াত, ই‘তেকাফ, দান-খয়রাতসহ অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির মাস। ত্যাগ-তিতিক্ষা, সংযম, সমবেদনা ও সহমর্মিতার বার্তাবহ এ মাস রমজান। রহমত (অনুগ্রহ), মাগফিরাত (ক্ষমা) ও নাজাতের (জাহান্নাম থেকে মুক্তির) মাস এ রমজান। পুরো মাসই রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত।
রমজান শব্দটি একটি আরবী পরিভাষা। এটি ‘রমাযা’ হতে গৃহীত। অনেকে রমজান, রমযান ইত্যাদি লিখে থাকে। সঠিক হল, রমজান শব্দের ‘মীম’ বর্ণে যবর হবে। সাকিন নয়। আল কুরআনেও রমজান শব্দের ‘মীম’ বর্ণে যবর ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘শাহরু রমাযানাললাযী উনযিলা ফিহিল কুরআন’ অর্থ-রমজানই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন…। (সূরাহ বাকারাহ, ১৮৩) হাদীসেও রমজান শব্দের ‘মীম’ বর্ণে যবর রয়েছে। রাসূল (সা) বলেন, ‘মান সমা রমাযানা ঈমানাও ওয়া ইহতিসাবা’ অর্থ-যে রমজান মাসের রোযা বিশ্বাসের সাথে ও সওয়াবের আশায় পালন করবে …।’ (ছিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত-পৃষ্ঠা-১৪৭) রমজান শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো দহন, জ্বলন ইত্যাদি।
রোযা রাখার কারণে ক্ষুৎ পিপাসার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলতে থাকে এ অবস্থাকে বুঝাবার জন্য আরবি ভাষায় বলা হয়, ‘রোযাদার দগ্ধ হয়’। এ থেকে গঠিত হয় উত্তাপের তীব্রতা। হাদীসেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন, ‘সূর্য উদয়ের পর সূর্যতাপে যখন প্রাচীর জ্বলে উঠে, তখন নফল নামায পড়ার সময়।’ (সহীহ মুসলিম)
হাদীসে ‘রমাযাত’ শব্দ দ্বারা সূর্যের তাপকে বুঝানো হয়েছে। সূর্যতাপের তীব্রতা পায়ে জ্বলন ধরিয়ে দেয় এবং ক্রমে সূর্যতাপ তীব্র হতে তীব্রতর হয়ে উঠে। মোটকথা রমজান অর্থ দহন, তীব্রতা। এ অর্থের দিক থেকে রমজান মাসটি হলো, অব্যাহত তীব্র দহনের সমষ্টি। আরবি মাসের নাম নির্ধারণকালে যে সময়টিতে সূর্যতাপ বেশী হওয়ার কারণে দহনশক্তি বেশী মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছিল সে সময়টির নামকরণ করা হয়েছে রমজান মাস। তখনকার সময়ের তাপ মাত্রার তীব্রতার সাথে এ নামকরণের পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্যতা রয়েছে।
রমজান মাসের নামকরণ সম্পর্কে বলা হয়, ‘এ মাসে যেসব সৎআমল করা হয়, তা সমস্ত গুনাহ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তাই এর নাম রাখা হয়েছে রমজান।’ (হাদীস শরীফ, ২য় খন্ড -১৭৭)
অন্যভাবে, ‘রমাযানের নামকরণ এজন্য করা হয়েছে যে, এ মাসে লোকদের হৃদয়-মন, ওয়াজ নসিহত ও পরকাল
চিন্তার কারণে বিশেষ উত্তাপ গ্রহণ করে থাকে যেমন সূর্যাতাপে বালু ও প্রস্তরসমূহ উত্তপ্ত হয়ে থাকে।’ (হাদীস শরীফ, ২য় খন্ড-১৭৭)
রমজান শব্দটির মধ্যে ৫টি অক্ষর রয়েছে। প্রতিটি অক্ষর এক একটি অর্থ বহন করে। যেমন: ‘রা’ দ্বারা রিযওয়ানুল্লাহ (আল্লাহর সন্তুষ্টি), ‘মীম’ দ্বারা মাগফিরাতুল্লাহ (আল্লাহর ক্ষমা প্রদর্শন), ‘যদ’ দ্বারা যিমানুল্লাহ (আল্লাহর যামিন হওয়া), ‘আলিফ’ দ্বারা উলফাতুল্লাহ (আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসা) এবং ‘নূন’ দ্বারা নিয়ামাতুল্লাহ (আল্লাহর নিয়ামত ও এহসানসমূহ) বুঝানো হয়। রমজান মাসের রোযার বদৌলতে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ রোযাদারের ভাগ্যে নসীব হয়।
বিশিষ্ট দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন, ‘মাহে রমজান আমাদের দুয়ারে উপস্থিত। রমজান শব্দের অর্থ দাহন, এক্ষেত্রেও রমজান অর্থ দাহন, তবে চিরতরে অগ্নিদগ্ধ করে কোন কিছুর বিলোপ নয়; আমাদের নানা রিপুর সংশোধন।’ মানুষের জীবনে কতগুলো রিপু রয়েছে। যেমন : কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মদ-মাৎসর্য। এদের সংখ্যার অতিরিক্ত আরও রয়েছে কুপ্রবৃত্তি। এসব মানুষের জীবনকে নানাবিধ অন্যায় ও অমঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। এজন্য তাদের সংশোধন করা প্রয়োজন। এদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করলে আবার মানব জীবন বিনষ্ট হবে।
কামবৃত্তির অতিরিক্ত চর্চা বা অপপ্রয়োগে মানব জীবনে দেখা যায় নানাবিধ অমঙ্গল ও অপকীর্তি। অথচ কামবৃত্তির সুপ্রয়োগের ফলেই এ পৃথিবীতে মানুষসহ সকল জীবের বংশ বিস্তার হচ্ছে।
ক্রোধের অপপ্রয়োগের ফলে ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে দেখা যায় বিবাদ-বিসম্বাদ, মারামারি ও হানাহানি। অথচ মানব জীবনে ক্রোধ না থাকলে মানুষ সিংহ, বাঘ, সাপ, কুমির, হাঙ্গর ইত্যাদি জীবের কবল হতে আত্মরক্ষা করে টিকে থাকতে পারত না।
মানব জীবনে লোভের অপপ্রয়োগের ফলেই হয় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, উৎকোচ প্রভৃতি নানা ধরনের অনাচারের সৃষ্টি। অথচ মানব জীবনে যদি উন্নত থেকে উন্নততর হওয়ার জন্য লোভের কার্যকারিতা না থাকত, তাহলে মানুষ উন্নত পর্যায়ে আরোহণ করতে পারত না। এভাবে অন্যান্য রিপুর কার্যকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করলে আমরা বুঝতে পারব, আমাদের টিকে থাকার জন্য এদের সুপ্রয়োগের প্রয়োজন। এদের এমনভাবে দগ্ধ করতে হবে যাতে তাদের দ্বারা আমরা সুফল লাভ করতে পারি। তারা যেন আমাদের কুপথে নিয়ে ধ্বংস করতে না পারে। এ রিপুগুলোর সংশোধনের একমাত্র কার্যকরী উপায় হল, রমাযানের রোযা। যা আল্লাহ রমজান মাসে ফরয করেছেন। ‘রময’ অর্থ জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়া। যেহেতু রমাযানের রোযা গুনাহসমূহ ও আত্মার সর্বপ্রকার কলুষতা ও অপবিত্রতাকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয় তাই এ মাসের নাম হয়েছে রমজান।
অনেকের মতে, রময অর্থ বসন্তকালের বৃষ্টি। এ বৃষ্টির প্রভাবে যেমন সবকিছু উপকৃত হয় তেমনি রমজান মাসের রহমাত, বরকত ও মাগফিরাতের বৃষ্টি থেকেও কোন মুসলমান বঞ্চিত হয় না। তাই এর নাম রাখা হয়েছে রমজান।
রমজান মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীরা! তোমাদের উপর রোযার বিধান দেয়া হলো, যেমন রোযার বিধান দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া (আল্লাহভীতি) অর্জন করতে পার।’ (সূরাহ বাকারাহ, ১৮৩)
রমজান মাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘রমজানই হলো সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কুরআন যা মানুষের জন্য দিশারি এবং সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী। সুতরাং যে এ মাস (রমজান) পাবে, সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।’ (সূরাহ বাকারাহ, ১৮৫)
রমাযানুল কারীম সম্পর্কে রাসূল (সা) বলেন, ‘(হে সাহাবীরা) তোমাদের নিকট বরকতময় রমজান মাস আগমন করেছে। এ মাসে রোযা রাখা মহান আল্লাহ তোমাদের উপর ফরয করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাগুলো (রহমতের দরজাসমূহ) খোলা হয়, জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করা হয় এবং শয়তানগুলোকে শৃঙ্খলিত করা হয়। আল্লাহর পক্ষ হতে এ মাসে তোমাদের জন্য এমন এক রাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যে রাতটি হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ইবাদত করা হলে অগণিত সওয়াব পাওয়া যাবে। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত, প্রকৃতপক্ষে সে যাবতীয় কল্যাণ হতে বঞ্চিত।’ (আহমাদ, নাসায়ী)
‘যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর ঈমান আনল, সলাত কায়েম করল, যাকাত আদায় করল, সিয়াম পালন করল রমজান মাসে মহান আল্লাহর কর্তব্য হয়ে যায় তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান।’ (সহীহ বুখারী)
এ মাসে লাইলাতুল কদর আছে যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। (সূরাহ কদর, আয়াত ৩)
এ মাসে দু‘আ কবুল করা হয়। ‘রমজান মাসে প্রত্যেক মুসলিমের দু‘আ কবুল করা হয়।’ (দুরুসুন রমাযানিয়া, মাজমু মুআল্লাফাতিল আলবানী)
‘ঐ ব্যক্তির নাক ধুলায় ধূসরিত হোক যে রমজান পেয়েও পাপগুলো মাফ করাতে পারল না।’ (জামেউল উসুল ফি আহাদিসির রসূল)
‘এ মাসের প্রতি রাতে বহু মানুষকে মহান আল্লাহ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন।’ ( আস সুনান আস সুগরা)
আতা (র) বর্ণনা করেছেন, ইবনে আব্বাস (রা)-কে তিনি বলতে শুনেছেন, রাসূল (সা) এক আনসারী মহিলাকে বললেন, আমাদের সাথে হজ করতে কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে? সে বলল, আমাদের পানি বহনকারী ২টি উট ছিল। আমার স্বামী ও ছেলে ১টি তে চড়ে হজ করে আর অপরটি আমাদের পানি বহনের জন্য রেখে যায়। রাসূল (সা) বললেন, রমজান মাস আসলে তুমি উমরা কর কারণ এ মাসের উমরা ১টি হজের সমান (সওয়াব সমান)।’ (সহীহ মুসলিম)
রাসূল (সা) বলেন, ‘হে জনগণ! তোমাদের উপর এক মহা পবিত্র ও বরকতময় মাস ছায়া দান করেছে। এ মাসের এক রাত মর্যাদার দিক থেকে হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ মাসের রোযা আল্লাহ তা‘আলা ফরয করেছেন এবং রাতগুলোতে আল্লাহর দরবারে দাঁড়ানোকে নফল করেছেন। যে লোক এ রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় সুন্নাত বা নফল ইবাদত করবে, সে অন্য মাসের ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করবে। আর যে লোক এ মাসে ফরয ইবাদত করবে সে অন্য মাসের ৭০ ফরয ইবাদতের সমান সওয়াব লাভ করবে।
এটা সবর (ধৈর্যের) মাস। আর সবরের পুরস্কার হলো, জান্নাত। এটা পরস্পর হৃদয়তা ও সৌজন্য প্রদর্শনের মাস। এ মাসে মু’মিনদের রিয্ক বৃদ্ধি করা হয়। এ মাসে যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করাবে, তার ফলশ্রুতিতে তার গুনাহ মাফ করা হবে এবং তাকে জাহান্নাম হতে মুক্তি দেয়া হবে…।’ (দুর্বল বর্ণনা, বায়হাকী, মিশকাত)
মাহে রমজান আমাদের শিক্ষা দেয় নিয়মানুবর্তিতা, প্রশিক্ষণ ও আর্তপীড়িত মানুষদের পাশে দাঁড়াতে।
লেখক, টিভি ও রেডিও আলোচক
* যাবতীয় লেখা ও মন্তব্যের জন্য লেখক দায়ী
