
পৃথিবীর আর কোন দেশকে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নেয়ার চাপ সামলাতে হয়েছে বলে জানা নেই। ২৫ আগষ্ট ২০১৭ তারিখের পর অন্তত ০৬ লক্ষ্যাধিক রোহিঙ্গা জাতিগত নিধনের কারণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অপরিকল্পিতভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ বিনষ্ট করে বসবাস করা শুরু করেছে। মিয়ানমার বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিবেশ, প্রাণ-প্রকৃতি, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক উন্নয়নে বৃহৎ সংখ্যার মানববোঝা দিয়ে আঘাত হেনেছে ও বিভিন্ন কৌশলে উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে যা মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রথম। …বিষয়টিকে শুধু মানবিক দিক বিবেচনা করে বর্তমান সরকার তাদের বাংলাদেশে আসার পথে রোহিঙ্গাদের জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেনি। বরং মানুষ হিসেবে যতটুকু মৌলিক অধিকার প্রাপ্য তার নিশ্চিতকরণ সহ অত্যন্ত শান্ত মেজাজে বর্তমানের এক নম্বর মহাবিপদকে সফলতার সাথে মোকাবেলা করছে। কিন্তু ২৫টি পাহাড় ও বনবেষ্ঠিত এলাকায় রোহিঙ্গারা থাকতে শুরু করায় বাংলাদেশের আকাশ, বাতাস, মাটি, পানি, বায়ু, শস্য, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, জলজ ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্র প্রভৃতির উপরে যে অপূরণীয় ক্ষতি তারা করা শুরু করেছে তা নিয়ে এখনই গভীরভাবে ভাববার সময় এসে গেছে।
পাহাড় কাটলে পাহাড় আর হবে না
পাহাড়কে প্রকৃতির পিলার বলা হয়। রোহিঙ্গারা পাহাড় কেটে প্রকৃতির পিলার ধ্বংস করেই চলেছে। তাদের বিচরণের এলাকা বর্তমানের হিমছড়ি ও ইনানী সী বিচের মত পর্যটন নগরীতেও চলে আসছে। অন্য দেশের মানুষ এসে মূলব্যান পাহাড় কেটে ঘর বানাচ্ছে..যেন মনে হচ্ছে দেশের আইনকানুনও নিরবতা পালন করছে। দেখার কেও নেই করার কিছু নেই। রোহিঙ্গারা ক্ষতি করবে আর তা চুপ করে জাতিকে দেখতে হবে? পরিবেশগত দিক দিয়ে আমরা হারাতে চলেছি এমন মূল্যবান আরো অনেক কিছুই।
রোহিঙ্গা সৃষ্ট পানি দূষণ
নতুন করে আসা অন্তত ০৬ লাখ মানুষের ভূগর্ভস্থ্ পানির ব্যাবহারের পরিমান কম নয়। মাটি খুঁড়ে হাজার হাজার টিউবওয়েল বসানোর ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যে নেমে যাচ্ছে। যার খেসারত পুরো বাংলাদেশের মানুষকেই দিতে হচ্ছে। এ নিয়ে কি পৃথিবীর কোন দেশ চিন্তিত? কই তারা তো প্রতিদিন তাদের দেশ থেকে বোতলজাত পানি অথবা পাইপ লাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করে দিচ্ছেনা। ধরা যাক প্রতিদিন ০৬ লাখ মানুষের কাপড় চোপড় যদি নূন্যতম ১০ লিটার ডিটারজেন্টযুক্ত পানিতে পরিষ্কার করা হয় তবে ৬০ লাখ লিটার পানি প্রয়োজন অর্থাৎ ১৫৮৫০৩২.৩১৪ গ্যালন পানি তারা দূষন করছে। আর ডিটারজেন্ট যুক্ত পানি পাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ করে। জল ও জীবনে ঘটে ছন্দপতন।
রোহিঙ্গারা সাথে করে এনেছে সংক্রামক রোগ
এমনিতেই মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের কোন টিকা বা ভ্যাকসিন দেয়া হয়না ফলে তারা বিভিন্ন রোগ বালাই নিয়েই বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেলেছে। আবার নারী পুরুষের অনেকেরই মরণব্যাধি এইডস এ আক্রান্ত। স্থানীয় অঞ্চলের মানুষরা এইডস আক্রান্ত নারীর সাথে মিলিত হলে তাদের শরীরে এইডস ছড়াতে কোন বাধা থাকবেনা। এছাড়া বাসস্থানের খুব কাছাকাছি অপরিকল্পিত ভাবে মলমূত্র ত্যাগের ফলে পানি দূষিত হচ্ছে। ০২ লাখের বেশি শিশু এসেছে যাদের মলমূত্রযুক্ত কাপড়চোপড় পরিষ্কার করে পানিকে দূষিত করে তারা নির্দিষ্ট স্থানে না ফেলে যত্রতত্র ফেলছে। ফলে মারাত্মকভাবে পানি দূষণ হওয়া শুরু করেছে। মনে রাখতে হবে এই পানিই বন্যপ্রাণী সহ কুকুর, বিড়ালও খাচ্ছে। ছড়াচ্ছে পানি বাহিত রোগ যা কিনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আসে পাশের অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ছে পর্যটন নগরী কক্সবাজার সহ বিভিন্ন অঞ্চলে।
শস্য ক্ষেত বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে
রোহিঙ্গারা আসছে টেকনাফ ও উখিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকা দিয়ে। কক্সবাজার ও বান্দরবনের বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে তারা এসমস্ত অঞ্চলেই বিচরণ করছে। বিভিন্ন পথ দিয়ে আসার সময় তাদের পায়ের আঘাতে বিনষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষকদের বোনা শস্য। সদ্য বেড়ে ওঠা ধানক্ষেতের ওপর হেটে আসার চিত্র দেখা গেছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে। এছাড়া আসার পথে তারা বিনষ্ট করেছে প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা সবুজ বন, ঘাস-লতা-পাতা, গুল্ম, শিকড়-বাকড় সহ সব কিছুই। প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা বনজ সম্পদ তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে।
বিপন্ন প্রাণ-প্রকৃতি
সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা হাজার হাজার পাখিগুলোর বাসা তো রোহিঙ্গারাই গুড়িয়ে দিয়েছে বড় বড় গাছগুলো কেটে..এই পাখিগুলো কোথায় থাকবে? একটি একটি করে শুকনো ঘাস দিয়ে তৈরী করা ঘর তারা কি কখনও ফেরত পাবে? ঘরে থাকা ছোট্ট পাখির বাচ্চাগুলোর কি হবে? জলজ প্রাণী ও বন্য প্রানীগুলো হয়ত নিশ্চুপ হয়ে যাবে; থাকবেনা তাদের চাঞ্চল্যতা। বন্য হাতি ক্ষুধার তাড়নায় দিক পরিবর্তন করে লোকালয়ে চলে এলে দ্বায়ভার কে নেবে?
বায়ূ দূষণ! সেটা আবার কি ভাবে?
ধরা যাক প্রতি পাঁচ জন সদস্য নিয়ে একটি রোহিঙ্গা পরিবার। মশার উৎপাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য প্রতিদিন ০৬ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে ১ লাখ ২০ হাজার পরিবার যদি কয়েল জ্বালায় তবে প্রতি রাতেই উক্ত অঞ্চল থেকে বিষবাষ্প উৎপন্ন হয়ে নির্মল বাতাসকে দূষিত করবে। কয়েল সৃষ্ট বিষাক্ত ধোঁয়ার ফলে কীটপতঙ্গের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রতিদিনের রান্নার জন্য তারা বিভিন্ন স্থান থেকে বিনামূল্যে গাছপালা কেটে তা জ্বালানির কাজে ব্যাবহার করছে। এত পরিমান মানুষের জ্বালানি কম নয়; ফলে কাঠ পোড়াবার সৃষ্ট ধোঁয়ার ফলে আশে পাশের আবাদী জমিতে ফলন ভালো হবেনা, গাছপালাও মারা যেতে থাকবে। এছাড়া শীতকালে কুয়াশার ফলেও উক্ত এলাকায় ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরী হবে। ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়তে থাকবে।
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ুর পরিবর্তন
মাটি, পানি ও বায়ু এই তিনটির দূষণ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গারা করে ফেলেছে। অতিবৃস্টি, অনাবৃষ্টি, এসিড বৃষ্টি, বন্যা, ধুলিঝড়, বজ্রপাত, জলোচ্ছ্বাস, সঠিক সময়ে শীত না পড়া সহ গুমোট আবহাওয়ার জন্য মানুষও দ্বায়ী থাকে। আর মানুষের কারণে সৃষ্ট জলবায়ুর পরিবর্তন কে এ্যনথ্রোপজেনিক বলে। যার জন্য এই ০৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা দ্বায়ী থাকবে। এছাড়া শব্দ দূষণ, পরিত্যাক্ত সেল ফোনের ব্যাটারী যত্রতত্র ফেলে দেয়া, মোবাইল টাওয়ার বসানো, প্রতিদিন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে পৌঁছানোর জন্য গাড়ির কালো ধোঁয়া সহ আরো ছোটখাটো কারণ তো আছেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধি তাও আবার হঠাৎ করে ০৬ লাখের কোটায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন যে কত ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে তা হয়ত জাতি হিসেবে আমরাই প্রথমে অনুধাবন করতে পারব। কেননা পৃথিবীর কোন বনাঞ্চল ও পাহাড় এলাকায় যদি ০২ মাসের মধ্যে ০৬ লাখ মানুষ বসতি স্থাপন করা শুরু করে তাহলে পরিবেশে কতমাত্রার ক্ষয়ক্ষতি হয় তা নিয়ে নিশ্চই বাংলাদেশের মানুষের থেকে ভিন দেশের মানুষ বেশী জানবে না।
সমাধানে অমাদেরই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে প্রথমে
গভীরভাবে চিন্তা করলে সহজেই অনুমেয় যে, অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া সংলগ্ন অঞ্চলগুলো তথা বাংলাদেশে। এমনিতেই জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকি প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম, তার উপরে রোহিঙ্গা সৃষ্ট কারণে হাজার হাজার একর আবাদী ও অনাবাদী জমি, সুপেয় পানি, বায়ু, পরিবেশ সবকিছুতেই যার পর নাই ক্ষতি হয়ে গেছে। যা স্থানীয় জনগনের পাশাপাশি পুরো দেশের মানুষকেই কঠিন এক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে সম্মুখীন করেছে। বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে অবস্থানের ফলে পরিবেশের যে অপুরণীয় ক্ষতি হতে চলেছে তা নিশ্চই মিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে পূরণ করা সম্ভব না। এর ক্ষতিপূরণ কি মিয়ানমার সরকার কোন সময় ফিরিয়ে দেবে? অর্থের বিনিময়ে তো আর বাস্তুবিদ্যার শৃঙ্গলতা ফিরে পাওয়া যাবেনা। প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা সবুজ গাছগুলো আর বাতাসে অক্সিজেন ছড়াবেনা। গাছের ডালে বাস করা হাজার হাজার পাখির কলকাকলিতে যে স্থান গুলো মুখরিত থাকতো তা হয়তো স্তব্ধ হয়ে যাবে। ….এত ক্ষতির ফলে জনগণ যদি তাদের মেজাজটা ধরে রাখতে না পারে সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সরকারও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে, কেননা জনগণের সিদ্ধান্তের প্রতিফলন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রকাশ পাবেই..তা যখনই হোক। তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশ অন্তত রোহিঙ্গা ইস্যুতে যাতে এক থাকতে পারে তার সবকটি চেষ্টা বাংলাদেশকেই চালিয়ে যেতে হবে। কুটনৈতিক কৌশলে বিজয় অমাদের আনতেই হবে তা যে কোন মূল্যেই হোক। আর একটুও পরিবেশগত কোন ক্ষতি না হোক, দূষণ মুক্ত থাকুক আমাদের পরিবেশ; বেঁচে থাকুক বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি; দেশীয় ও অতিথি পাখিরা খুঁজে পাক তার নিরাপদ আশ্রয়, ফিরে আসুক পাহাড় ও বনাঞ্চলের রুপ-সৌন্দর্য ।
তামীম শাহরিয়ার শোভন
গণমাধ্যম কর্মী

চমৎকার, ঝকঝকে উপস্থাপনা…
Thanks Hirok