
সাখাওয়াত হোসেন
হুইস্কি, ওয়াইন, শ্যাম্পেন যা-ই হোক না কেন, আমরা সরল বাংলায় এগুলোকে মদ বলি। মদ, মদ্যপান, মদ্যপ, মাতাল, মাতলামি শব্দগুলো প্রচলিত এবং আমাদের সমাজ ও ধর্মীয় ব্যবস্থায় মদ্যপান মানুষের জন্য কল্যাণকর নয়।
অনেক উন্নত দেশে মদ্যপান একটি সম্মানজনক রেওয়াজ। ভুটানে মদ্যপ হলে ক্ষতি নেই, আপনি সরকারি সুরক্ষা পাবেন। আবার ওই দেশে প্রকাশ্যে সিগারেট টানলে আপনাকে জরিমানা গুনতে হবে।
স্কুল জীবনে আমজাদ হোসেনের ‘সুন্দরী’ চলচ্চিত্রে মাতাল মেথর ও প্রিয়তমা স্ত্রীর অনবদ্য অভিনয় দেখেছিলাম। অভিনয় করেছিলেন সাইফুদ্দিন ও আনোয়ারা। ওই অভিনয় দেখে মনে মনে ভাবতাম, আমি যদি অমন মাতাল মেথর হতে পারতাম আর আনোয়ারার মতো মেথরানি প্রেমিকা যদি কপালে জুটতো, আহা…! আমাদের মনের ভেতর কখন কোন ভাবনা কীভাবে আলোড়িত হয় তার খবর আমরা জানি না।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের কথা। মালদ্বীপের ইব্রাহীম নাসির আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টের ডিপারচার লাউঞ্জে মদের বিশাল মল দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। মলটি ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়লো একটি রাজকীয় হুইস্কি। মূল্য ৫০ হাজার ৮৮৮ ইউএস ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় বর্তমানে ৫০ লক্ষ টাকার উপরে। এক বোতল মদের দাম ৫০ লক্ষ টাকা। কী সাংঘাতিক!
ভাবলাম, আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষ জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ৫০ লক্ষ টাকার সম্পদ দেখে যেতে পারেন না। অথচ বিত্তবানরা কয়েক মিনিটে ৫০ লক্ষ টাকার হুইস্কি পান করে আনন্দ উপভোগ করেন। বড় বিচিত্র এই বিশ্বপ্রকৃতি।
হুইস্কি বা ওয়াইন গাঁজনকৃত আঙুরের রস থেকে তৈরি করা হয়। প্রাকৃতিকভাবে আঙুরে রাসায়নিক উপাদানগুলো ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় থাকে। এ কারণে অতিরিক্ত চিনি, এসিড, এনজাইম বা অন্য কোনো উপাদান এতে যোগ করা ছাড়াই গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়। এরপর বিভিন্ন ইস্ট ব্যবহার করে গাঁজনকৃত ওই আঙুরের রস থেকে হুইস্কি বা ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়। আপনারা জানেন, আঙুর বা দ্রাক্ষা ফলটি লতা জাতীয় দ্রাক্ষালতা থেকে উৎপন্ন হয়।

ইস্ট আঙুরের রসে থাকা চিনিকে অ্যালকোহলে পরিণত করে। ওয়াইনের মান নির্ভর করে বিভিন্ন আঙুর ও ইস্টের প্রকারভেদের ওপর। আপেল ও জামের গাঁজন থেকেও ওয়াইন প্রস্তুত করা হয়। সেসব ক্ষেত্রে ফলের নামানুসারে ওয়াইনের নামকরণ করা হয়। যেমন- অ্যাপল ওয়াইন, এলডারবেরি ওয়াইন। এছাড়াও রয়েছে বার্লি ওয়াইন, রাইস ওয়াইন, জিঞ্জার ওয়াইন ইত্যাদি। পণ্ডিতগণের মতে, আঙুর চাষ ও ওয়াইন উৎপাদনের প্রক্রিয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আঙুর গাঁজিয়ে ওয়াইন প্রথম তৈরি করা হয় জর্জিয়া ও আর্মেনিয় ভূখণ্ডে।
শুরুর দিকে ফলটি আঙুর (বৈজ্ঞানিক নাম : Vitis vinifera) ছিল কি না সন্দেহ রয়েছে। ধারণা করা হয়, ফলটি ছিল বুনো আঙুর। বুনো আঙুর আকারে ছোট আর স্বাদে টক হয়। মানবসভ্যতায় ওয়াইনের ইতিহাস ৮ হাজার বছরের পুরনো। প্রাচীন যুগে এই আঙুর-ওয়াইনকে পানি ও দুধের চেয়েও নিরাপদ মনে করা হতো। তারা মনে করতেন, ওয়াইন রোগ বালাই দূর করে। প্রাচীন সভ্যতায় একে ‘দৈব আশীর্বাদ’ মনে করা হতো।
বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্বে প্রায় পৌনে তিন কোটি টন ওয়াইন প্রতি বছর তৈরি হচ্ছে। ওয়াইন উৎপাদনের দিক থেকে প্রথম সারির দেশ হচ্ছে ইতালি, এদের উৎপাদন ১৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে ফ্রান্স, স্পেন ও আমেরিকা। বছরে প্রায় ১৬ লাখ টন ওয়াইন বা মদ উৎপাদন করে বিশ্বে পাঁচ নম্বরে রয়েছে চীন। ৬ থেকে ৯ নম্বরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আফ্রিকা, চিলি ও জার্মানি। আর ওয়াইন খাওয়ার দিক থেকে বিশ্বে প্রথম সারিতে রয়েছে মলদোভার নাগরিকগণ। দেশটিতে মাথাপিছু বছরে মদ খাওয়ার পরিমাণ ১৮.২২ লিটার।
এই ফাঁকে একটা গল্প বলি। পারস্যের এক রাজকন্যা সম্রাটের সুনজর থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষোভে-অভিমানে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। একটি জারে ছিল আঙুরের বহুদিনের বাসি রস। ওই রসকে বিষ মনে করে পান করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু রস পান করার পর রাজকন্যা অবাক হলেন। একি! সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে যে! মৃত্যুর বদলে জেগে উঠেছে চাঙা মনোবল। আঙুরের এই বাসী রসের আশ্চর্য গুণের কথা রাজকন্যা সম্রাটকে বললেন। সম্রাট বড়ই সন্তুষ্ট হলেন। এভাবেই রাজকন্যা ফিরে পেলেন তাঁর প্রেম-ভালোবাসা। অবশ্য এসবই গল্পগাঁথা। ওয়াইন বা মদের আবিষ্কার আরও পুরনো। সাম্রাজ্য ও রাজকন্যা সৃষ্টিরও আগে, সেই ট্রাইবাল যুগে।
যাহোক, এতোদিন জানতাম, বিশ্বের সবচেয়ে দামি ওয়াইন বা মদ কিনতে ১৫ হাজারেরও বেশি ডলার গুনতে হয়। কিন্তু মুসলিম দেশ মালদ্বীপে গিয়ে দেখলাম, এক বোতল মদের দাম ৫০ হাজার ৮৮৮ ডলার, অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫০ লক্ষ টাকারও বেশি। এতোদিনে দাম আরও বেড়ে গেছে কি না, জানি না। যাক মদ মদের জায়গায় থাক। কারণ দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি ও বিদ্যুৎ নিয়ে আমাাদের মাথা এখন ঘুরছে।
