
কালো মেয়েকে উজ্জ্বল শ্যামলা বলার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীতে আসতে না আসতেই একটি কন্যা সন্তানকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে হয় তাও আবার নারীদের কাছ থেকেই। কন্যা সন্তান জন্মের পর নাক বোঁচা হয়েছে বলতে প্রায়শই শোনা যায়। ফর্সা না হলে নবজাতিকার মায়ের সামনেই বলা হয়, রং আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে যাবে। আর এটা বেশি বলে থাকেন নবজাতিকার দাদী-নানী-খালা-ফুফু-মামী বা মহিলা প্রতিবেশী। অর্থাৎ সমাজের নারী অভিভাবকগন কিছুটা হলেও দায়ী বর্ণবৈষম্যের এই ধারনা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আর সেই ধারনাকে কাজে লাগিয়ে কিছু বহুজাতিক কোম্পানি প্রসাধনী সামগ্রী তৈরি করে।
শিশু বয়সে যে পুতুল খেলে মেয়েরা বড় হয় সেই পুতুলেরও রং থাকে হালকা গোলাপী বর্ণের যা ফর্সা রংকেই বোঝায়। এরপর আসে কিশোরী বয়স। এই বয়স থেকেই মেয়েরা তার নিজের শরীরের যত্ন নেয়া, হালকা সাজগোজ, কিভাবে স্লিম থাকা যায় তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। টেলিভিশনে বহুজাতিক কোম্পানির রং ফর্সাকারী প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়। তাদের মস্তিষ্কে বারংবার বিজ্ঞাপনগুলোর বার্তা গেঁথে যায়।
বিভিন্ন সুন্দরী প্রতিযোগীতা থেকে তারা শিখে ফর্সা সুন্দরী হলে মিস বাংলাদেশ হওয়া যায়। তারা শিখতে থাকে ফর্সা হলেই তাকে ছেলেরা পছন্দ করবে। আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে মেলে ধরা যাবে। সমাজে ভালো অবস্থান করে দেবে বা ক্যারিয়ারে সাফল্য এনে দেবে। বাসা থেকে বের হলেও রক্ষা নেই, রাস্তার মোড়ে মোড়ে অথবা স্কুল ভবনের সামনে বিখ্যাত তারকাদের বিলবোর্ড দেখে তাদের মতো ফর্সা সুন্দরী হবার বাসনা অনেক মেয়েরাই করে থাকেন। আবার টেলিভিশনের পর্দায় হিন্দী সিরিয়ালের যে কয়টা কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র থাকে তাদের সবাই ফর্সা না হলেও মেকআপ করে ফর্সাই দেখানো হয়। আবার সংবাদ উপস্থাপিকাকেও কড়া মেকআপ দিয়ে ফর্সা বানানো হয়। ফলে সংবাদ উপস্থাপিকা হতে হলে ফর্সা হতে হয় এ অবান্তর ধারনা তরুনীদের মনে এসে যেতেই পারে!
এর মধ্যে যোগ হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সুন্দরীদের বাছাই প্রতিযোগীতা। অর্থাৎ বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিলবোর্ড আর টিভির বিজ্ঞাপনেই সীমাবদ্ধ নেই; তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করছে। যেখানে শরীরের বিভিন্ন অংশ সুন্দর হতে হবে, স্লিম হতে হবে, লম্বা হতে হবে এমন উদ্ভট মানদন্ডের কথা বলা হচ্ছে। ফলে একজন কালো মেয়ে নিজের গায়ের রং বা ফিগার নিয়ে আফসোস করতে থাকে। এ ধরনের প্রতিযোগীতা মেয়েদের আত্ববিশ্বাসী বানানোর চটকাদার বাক্য ব্যবহার করলেও কালো বা শ্যামলা সুন্দর মেয়েদের আত্মবিশ্বাস যা ছিল সেটুকুও কেড়ে নিচ্ছে। কোন কোম্পানির ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হতে গেলে নিশ্চয়ই ফর্সা হতে হয়না। কিন্তু একজন মোটা বা কালো রংয়ের মেয়ে মনে করতেই পারে ঐ অবস্থানে সে হয়ত যেতে পারবেনা। এভাবে ফর্সা হওয়ার চেষ্টা জীবনের শেষ পর্যন্ত চলতে থাকে।
এবারে বিয়ে প্রসঙ্গ: বিয়ের জন্য পাত্রী খোঁজা মানেই যেন বউয়ের গায়ের রং হতে হবে দুধে আলতা। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে ফর্সা তরুণীদের খোঁজা হয় ছেলের গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হবার জন্য। ফর্সা সুন্দর মেয়ে হতে হবে না হলে উচ্চবিত্তের মান যাবে। মেয়ে কালো হলেও বলা হয় উজ্জ্বল শ্যামলা। বিয়ের পর আরো ফর্সা হয়ে যাবে। তার মানে কি মেয়েদের শুতে বসতে চলতে ফিরতে জীবনের লক্ষ্যেই ফর্সা সুন্দরী হওয়া!
এই অস্বাভাবিক দৌড়ের জন্য বহুজাতিক কোম্পানি কি অনেকাংশেই দায়ী নয়? বিজ্ঞাপন তৈরীর সময় কোম্পানীর দায়িত্বরত গবেষকেগন তাদের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নারীকে ফর্সা হবার জন্য তাগাদা দিতে থাকে। কনসেপ্ট তৈরী করে এমন ভাবে যেন ফর্সা না হলে সমাজের কেও তাকে সুন্দর বলবেনা। আর তাদের বিজ্ঞাপনের ম্যাসেজ থাকে মাত্র ১৫ দিনে রং ফর্সা করার গ্যারান্টি, তা সাবান হোক আর ক্রিমের বিজ্ঞাপন হোক ।
এটা বুঝতে হবে রং শ্যামলা, কালো বা ফর্সা হওয়া নির্ভর করে ত্বকে মেলানিনের মাত্রার উপর। যার শরীরে মেলানিনের মাত্রা বেশী সে কালো আর যার কম সে ফর্সা হবে এটাই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। এছাড়াও মানুষ যে পরিবেশে বাস করে তার তাপমাত্রা, মাটি, সূর্যের আলোর উপরেও কিছুটা তারতম্য হয়। এছাড়া বংশগত কারণ তো আছেই।
ত্বক সুন্দর রাখতে মেয়েরা আদিকাল থেকেই বিভিন্ন রূপচর্চা করে নিজেদের পরিপাটি রেখেছে যা স্বাভাবিক। অর্থলোভী দেশি বা বহুজাতিক কোম্পানি তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য সাদা কালোর মানুষের মাঝে বৈষম্য তৈরি করেই যাবে। তাই বলে আমরা অভিভাবগন নিশ্চই বসে থাকবনা। শৈশব থেকে কৈশরে পদার্পনের সময় তাদের বোঝাবো তুমি তোমার মত হও অন্যের মতো হবার একটুও প্রয়োজন নেই তোমার। তোমার আত্ববিশ্বাস ও সৌন্দর্য আসে মন, মনন ও মেধা থেকে…ফর্সা সুন্দরী হবার মাধ্যমে নয়। শিক্ষায় অর্জিত জ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তুমি যেকোন প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারো। সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হতে পারো; পেতে পারো তারকা খ্যাতিও। ছড়িয়ে দিতে পারো নিজের আলো।
তামীম শাহরিয়ার শোভন
মিডিয়া কর্মী।

চমৎকার বলেছেন ভাই… চলুক আপনার কলম। আমরা সবাই সচেতন একদিন হবই হব।
ধন্যবাদ
valo hoyese
ভালো লিখেছেন।
A lot of thanks