
মানব সভ্যতার প্রায় শুরু থেকে মানুষ পারস্পরিক লেনদেন সম্পন্ন করতে মুদ্রা ব্যবহার করে আসছে। বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন অঞ্চলে সরাসরি পণ্য বিনিময় প্রথা বা barter system থাকলেও হাজার বছর ধরে সভ্য সমাজ লেনদেনের জন্য কোনো না কোনো ধরনের মুদ্রা ব্যবহার করে আসছে। মূলত লেনদেনের সুবিধার জন্য মুদ্রাই হয়ে ওঠে প্রধান মাধ্যম। কড়ি থেকে স্বর্ণ- রৌপ্য, হাতির দাঁত থেকে মণি-মুক্তা – অনেক কিছুই ব্যবহার হয়েছে মুদ্রা হিসেবে। তবে বিগত শতাব্দী থেকে কাগুজে মুদ্রাই হয়ে ওঠে মুদ্রার প্রধান রূপ। কমপিউটার আবিষ্কারের পর থেকে বিগত কয়েক দশকে ডিজিটাল মুদ্রা দ্রুত অর্থনীতিতে জায়গা করে নিতে থাকে। ডিজিটাল মুদ্রার কাগুজে বা অন্যান্য মুদ্রার মতো ভৌত রূপ নেই এবং তা শুধুই কমপিউটার বা ভার্চুয়াল জগতে বিদ্যমান থাকে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা যে ইন্টারনেট ব্যাংকিং অথবা যে মোবাইল ব্যাংকিং (যেমন বিকাশ বা রকেট) এর মাধ্যমে লেনদেন করি মূলত তাই ডিজিটাল মুদ্রা। মুদ্রার এই বিবর্তনের ধারাতেই বর্তমান দশকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে নতুন একটি ধারণা – ক্রিপ্টোকারেন্সি।
ক্রিপ্টোকারেন্সি (cryptocurrency) বা ক্রিপ্টোমুদ্রা হল এমন এক বিশেষ ধরণের ডিজিটাল মুদ্রা যা কমপিউটারের মাধ্যমে গুপ্ত সাংকেতিক লিপি বা ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে লেনদেন সম্পন্ন করে। এটিএম থেকে টাকা তুলতে যেমন পিন নম্বর বা আপনার ফেসবুকে ঢুকতে যেমন পাসওয়ার্ড, তেমনি এই গুপ্ত সাংকেতিক লিপি লেনদেনটি যে ঠিকমতো হচ্ছে তা নিশ্চিত করে। ক্রিপ্টোমুদ্রা ডিজিটাল মুদ্রারই এক বিশেষ রূপ। একে বিকল্প মুদ্রার (alternate currency) এক বিশেষ রূপও ধরা হয়। বিগত এক দশকের কিছু কম সময়ে এই ক্রিপ্টোমুদ্রাই হয়ে ওঠে অর্থনীতির জগতে বহুল আলোচিত বিষয়। আর এ সকল আলোচনার পেছনে রয়েছে পৃথিবীর প্রথম ক্রিপ্টোমুদ্রা ‘বিটকয়েন’।
বিটকয়েনের শুরুটা হয় ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট, যেদিন bitcoin.org নামক একটি ওয়েবসাইটের ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করা হয়। সেই বছরেই নভেম্বরে ‘সাতোশি নাকামোতো’র (Satoshi Nakamoto) নামে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়, যার শিরোনাম ছিল Bitcoin: A peer-to-peer Electronic Cash System। তবে এই ‘সাতোশি নাকামোতো’ কোনো ব্যক্তি, সংঘ নাকি দল তা এখনো জানা যায়নি। ধরা হয় এটি একটি ছদ্মনাম এবং এর পেছনে কে বা কারা আছে তা এখনো অজানা। ২০০৮ এর চরম বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে সরকার এবং ব্যাংকগুলোর ব্যর্থতার প্রতিবাদস্বরূপ এই বিটকয়েনের আবিষ্কার বলে অনেকেই ধারণা করেন; কারণ বিটকয়েনই এমন এক মুদ্রা যাতে অন্যান্য মুদ্রার মতো কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নেই। তবে ২০০৮এ শুরু হলেও বিটকয়েনের প্রথম লেনদেনটি সম্পন্ন হয় ২০০৯ এর ৩ জানুয়ারি। এই প্রথম লেনদেনে কমপিউটার প্রোগ্রামার হ্যাল ফিনে (Hal Finney) বিটকয়েনের প্রোগ্রামটি প্রথম ডাউনলোড করার জন্য সাতোশি নাকামোতোর কাছ থেকে ১০টি বিটকয়েন পান।
এই লেনদেনের মাধ্যমে বিটকয়েনের ডিজিটাল লেজারটি (Digital Ledger) তৈরি হয়। এই লেজারটি সাধারণত অফিসে ব্যবহৃত লেজার খাতার মতোই একটি কমপিউটার লেজার, যেখানে বিটকয়েনের মাধ্যমে সম্পন্নকৃত সকল লেনদেনের হিসাব থাকে। সকল বিটকয়েন ব্যবহারকারীর কমপিউটারেই এই লেজারের একটি ডিজিটাল কপি থাকে, যা নিয়মিত হালনাগাদ হয়। কোনো লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার জন্য লেনদেনটি অনেকগুলো কমপিউটারে প্রেরণ করা হয় যেখানে কমপিউটারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরীক্ষা করে দেখে যে লেনদেনটি বৈধ কি না। পূর্বে যে গুপ্ত সংকেত বা ক্রিপ্টোগ্রাফির কথা বলা হল, সেটিই এই পরীক্ষার ক্ষেত্রে কাজে আসে। যথেষ্ট সংখ্যক কমপিউটার যদি লেনদেনটি সঠিক হিসাবে চিহ্নিত করে তবেই তা বৈধতা পায় এবং পৃথিবীর যে সকল কমপিউটারে বিটকয়েন লেজার আছে তাতে লেনদেনটি হালনাগাদ করা হয়। এই ডিজিটাল লেজারটিকে ব্লকচেইন (Blockchain) নাম দেওয়া হয়েছে।
এই ব্লকচেইনটি সঠিকভাবে রক্ষা করার জন্য লেনদেনের ক্ষেত্রে যে ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহৃত হয় সেখানের গুপ্ত সংকেতগুলোর সমাধান করতে হয়। এর জন্য দরকার পড়ে কমপিউটারের প্রসেসিং ক্ষমতা ব্যবহারের। ব্যবহারকারীরা কমপিউটার ব্যবহার করে এই সংকেতগুলোর সমাধান করে এবং ব্লকচেইনটিকে কার্যকর রাখে। প্রতিবার ব্লকচেইন সমাধানের জন্য সমাধানকারী কমপিউটারের ব্যবহারকারীরা পুরস্কার হিসেবে পান নতুন বিটকয়েন। আর এভাবেই তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন বিটকয়েন এবং বাজারে বিটকয়েনের সরবরাহ বাড়তে থাকে। এভাবে নতুন বিটকয়েন তৈরির প্রক্রিয়াকে বলে ‘মাইনিং’ (mining); বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় ‘খনি থেকে উত্তোলন’।
তবে সকল নতুন ব্যবস্থার মতই বিটকয়েনেরও সুবিধা-অসুবিধা উভয়ই আছে। বিটকয়েন যেহেতু একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি তাই এর সম্পূর্ণ মালিকানা নির্ভর করে আপনার কমপিউটারে রক্ষিত ফাইলটির ওপর। আপনার ব্যক্তিগত ফাইলটিকে বলে আপনার ওয়ালেট (Wallet) যাতে কিনা আপনি যতগুলো বিটকয়েনের মালিক সেগুলো রক্ষিত। কোনো কারণে ফাইলটি মুছে গেলে আপনার সকল বিটকয়েনও তার সাথেই হাওয়া হয়ে যাবে। আবার আপনার ব্যক্তিগত ফাইলের ক্রিপ্টোগ্রাফির যে গোপন তথ্য (Private key) তা যে কেউ জেনে গেলে সেও বাধাহীনভাবে আপনার বিটকয়েনগুলো ব্যবহার করতে পারবে। যেহেতু কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা নেই, সেহেতু এসব ক্ষেত্রে প্রতিকার বা ন্যায় চাওয়ার কোন জায়গাও নেই।
বিটকয়েন নিয়ে হইচই শুরু হয় যখন ২০১৬ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিটকয়েনের মূল্যমান ১০ গুণেরও বেশি হয়ে যায়। এই আকস্মিক উত্থানের মধ্যে অবশ্য অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যও দেখছেন। অনেক অর্থনীতিবিদই এটি একটি Ponzi Scheme বা Pyramid Scheme অর্থাৎ লোককে ফাঁদে ফেলে ঠকানোর এক ধরণের বিশেষ কৌশল। তবে বিশ্বব্যাংক এধরণের দাবি ইতিমধ্যে নাকচ করে দিয়েছে। আবার অনেকে বলছেন গুজবের ওপর ভিত্তি করে বিটকয়েনের মূল্য হচ্ছে যাকে কিনা speculative bubble বলে। এমন ক্ষেত্রে যেকোনো সময় বড় ধরনের দরপতন হয়ে অনেক ব্যবহারকারীকেই নিঃস্ব করতে পারে। খোদ বিটবয়েনের দুজন মুখ্য প্রোগ্রামার এ বিষয়ে সম্পর্কে সচেতন করেছেন। তাছাড়া ঠিক একই ধরনের দরবৃদ্ধির পর এমন সন্দেহ একবারে অলীক বলা যায় না।
সকল সন্দেহ ও সুবিধা-অসুবিধার মধ্যে থেকেই বিটকয়েন নতুন শতাব্দীতে নতুন ধরনের মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সির পথ ক্রমেই সুগম হচ্ছে। এই বিটকয়েনের পথ ধরেই ইথারিয়াম, রিপল, লাইটকয়েনসহ অনেক নতুন ক্রিপ্টোমুদ্রা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপি ছড়িয়ে পড়েছে। একমাত্র ভবিষ্যতই ক্রিপ্টোমুদ্রার গতিপথ বাতলে দিতে পারে। এ মুহূর্তে বসে তা নির্ণয়ের চেষ্টা নিছক ঘোড়ার যুগে বসে ই-মেইলের বাস্তবতা নির্ণয়ের মতোই নিষ্ফল।
লেখক: উদ্যোক্তা ও গবেষক

Good writing indeed.