
শুভ কিবরিয়া
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনে জিতে বিজেপি সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। গুজরাটে কংগ্রেস আগের চেয়ে ভাল করলেও হিমাচল প্রদেশে বিজেপি যথেষ্ট ভাল করেছে। দুই রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন ভারতের ভোটের সাম্প্রতিক রাজনীতির হালচালের একটা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে। বিশেষত গুজরাটের নির্বাচনের ফলাফল ভারতের আগামী দিনের রাজনীতির গতি-প্রকৃতির একটা আগাম আভাসও দিচ্ছে। দিচ্ছে কিছু সতর্কবার্তাও:-
গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির অনুকূলে গেছে। বহুল আলোচিত গুজরাটে বিধান সভার ১৮২ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ৯৯ টি আসন। গতবারের চেয়ে ১৬ টি আসন কম পেয়েছে বিজেপি। ২২ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পর এবারই বিজেপি বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এ রাজ্যের নির্বাচনে।
বহু বছর ধরে গুজরাট শাসন করছে বলে বিজেপির নিজের যেমন অহং আর ক্ষমতার দম্ভ তৈরি হয়েছিল জনগণও তেমনি ছিল নানা কারণে ক্ষুব্ধ। খোদ নরেন্দ্র মোদিকে তাই নিজে সামলাতে হয়েছে এ রাজ্যের নির্বাচনি প্রচারণা। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শা’র নিজ রাজ্য গুজরাট। মোদি-অমিত শাহ জুটির নির্বাচনি সাফল্য অতীতে দেখেছে গোটা ভারত। এবারও তাই অমিত শাহ ছিলেন অধিক আত্মবিশ্বাসি। অমিত শাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন গুজরাটে তারা ১৫০ টি আসন পাবেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতির এই ঘোষণা গুজরাটের ভোটার নাকচ করে দিয়েছে। ৯৯ আসন নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
বিজেপি এবারও গুজরাটে সরকার গঠন করবে নির্বিঘ্নে । কিন্তু গুজরাট বিধানসভায় শক্তিমান বিরোধি দল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে কংগ্রেস। কংগ্রেস ও তার মিত্ররা এবার এখানে ৮০ টি আসন পেয়েছে। গতবারের চেয়ে ১৯ টি আসন বেশি পেয়েছে কংগ্রেস। সে হিসাবে সরকার গঠন করতে না পারলেও কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধীর জন্য গুজরাটে এটা একটা বড় অর্জন। গুজরাটে বিজেপির প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটারদের সফলভাবেই একাট্টা করতে পেরেছেন রাহুল গান্ধী । তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এটা একটা নতুন পালক হিসাবে দেখা দেবে। ভারতের রাজনীতিতে ঝিমিয়ে পড়া কংগ্রেস রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে নতুন করে জেগে ওঠার প্রেরণা পেতে পারে গুজরাটের এই ভোটের লড়াই ও তার ফলাফল থেকে।
নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের নির্বাচন নিয়ে চাপে ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার সকল সুবিধা ব্যবহার করে তিনি সর্বশক্তি দিয়ে এবার নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছেন গুজরাটে। ভোটের শেষ দিকে এসে মোদি তার ব্যাক্তি ইমেজকেও কাজে লাগিয়েছেন। শুধু তাই নয় , মোদি শেষ পর্যায়ে এসে হিন্দুত্ববাদ , সাম্প্রদায়িকতা, পাকিস্তান বিরোধিতার মতো তাঁর পুরনো অস্ত্র ব্যবহার করতেও কসুর করেননি। এবং শেষাবধি তা ভোটের ফলাফলকেও কিছুটা প্রভাবিত করেছে।
গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেস বেশ কিছু সাফল্য পেয়েছে। প্রথমত একটা ভাল ভোটের লড়াই তৈরী করে বিজেপিকে দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ঠেলেছে। ভোটের মাঠে বিজেপিবিরোধি সকল শক্তিকে এক কাতারে এনে একটা যুথবদ্ধ ভোটলড়াই তৈরির এই মডেল অপরাপর রাজ্যগুলোতে কংগ্রেসকে পথ দেখাতে পারে।কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হিসাবে রাহুল গান্ধী ভবিষ্যতে এই গুজরাট মডেলকে কাজে লাগাতে পারে।
নরেন্দ্র মোদির সর্বভারতীয় অবস্থান তৈরির সূতিকাগার হচ্ছে গুজরাট। তাঁর আলোচিত ‘গুজরাট উন্নয়ন মডেল ’এবারের নির্বাচনে হালে পানি পায় নাই। অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাতপদ বড় অংশের ভোটাররা মোদির উন্নয়ন মডেলেকে গুরুত্ব দিতে রাজী হয় নাই। বরং মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদি জাগরণ অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে ভোটারদের। এই ধর্মভাবাপন্নতা খোদ কংগ্রেসকেও প্রভাবিত করেছে। এবারের ভোটে তাই কংগ্রেস ‘সফট-হিন্দুত্ববাদি’ লাইন নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। রাহুল গান্ধী নির্বাচনের সময় অনেক মন্দির ঘুরেছেন ভোটারদের মন জোগাতে।
নরেন্দ্র মোদি আওয়াজ তুলেছেন তিনি কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়তে চান। গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে বিজেপির বিজয় অন্যান্য প্রদেশে বিজেপির জয়যাত্রা অব্যাহত রাখতে প্রণোদনা জোগাবে । যে কোন মূল্যে, যে কোন কায়দায় নির্বাচনে জিততে এবং কংগ্রেসকে আরও কোণঠাসা করতে বিজেপি এখন তাই আরও মরিয়া হয়ে উঠবে।
গুজরাটের নির্বাচন নানাভাবে সতর্কবার্তা ছড়াচ্ছে।
বিজেপির সামনে বড় চ্যালেঞ্জ আছে। যত সহজভাবে তারা আগামী বছর সংসদ নির্বাচনে ভোটে জিতবে বলে ভাবছে সেটা অতটা সহজ নাও হতে পারে। গুজরাটের মতো সর্বত্র বিজেপি বিরোধিরা একত্র হতে পারলে বিজেপির জন্য বড় বিপদ আছে সামনে।
ভোটে জিততে আদর্শ ও নীতির ক্ষেত্রে কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে কংগ্রেসকে। ভোটের রাজনীতিতে বিজেপির মতো ধর্মকেও ব্যবহারের সুবিধা নিতে চাইছে কংগ্রেস। ফলে, ভারতীয় রাজনীতিতে উদারপন্থা আর অসাম্প্রদায়িকতার পথ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
