
জববার হোসেন
প্রথম দিনের পরিচয়ে মনে হয়নি মোটেও, দিনটি প্রথম। মনে হয়েছে অনেককালের চেনা আমার, অনেক দিনের জানা। অনেকদিন থেকে আমি তাকে, তিনি আমাকে চেনেন। অথচ মোটেও তা নয় কিন্তু। আনিসুল হক সম্পর্কে উচ্ছসিত হবার যত মানবিক গল্প তার সবটাই শোনা আমার বড় ভাই আব্দুন নূর তুষারের কাছে। তুষার ভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে থাকলে নিয়মিত যে কয়জনের ফোন আসতো টের পেতাম, তার মধ্যে একজন আনিসুল হক। তুষার ভাইয়ের, আনিস ভাই, বড় ভাই। নিজের ভাই-ই, অভিভাবকই মনে করতেন তুষার তাকে। এখনও তাই।
‘সাপ্তাহিক কাগজ’ এর সম্পাদক তখন আমি। কাগজ সামাজিক রাজনৈতিক সাপ্তাহিক। সচেতনতামূলক অনেক কর্মকা-ের সঙ্গে ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ এর সম্পৃক্ততা ছিল। দেশে যখন বিদ্যুৎ সংকট প্রবল, বলা হতো, বিদ্যুৎ যায় না, মাঝে মাঝে আসে; তখন ‘সাপ্তাহিক কাগজ’ ও ‘সুচিন্তা ফাউন্ডেশন’ যৌথ উদ্দ্যোগে একটি সেমিনার আয়োজন করেছিল। মূলত সেমিনারটির সূত্র ধরেই আনিসুল হকের সঙ্গে পরিচয়, সেমিনারের মাত্র ক’দিন আগে। বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে তার কিছু পরামর্শ ছিল, অন্য অনেকের সঙ্গে। সাধারণত বড় মানুষদের ক্ষেত্রে দেখেছি কেবল নিজের পরামর্শ বা যুক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে দেখা যায় নিজের বক্তব্য দেয়া হলে, অন্যেরটা না শুনে আসন ও কক্ষ দুই-ই ছাড়েন। কিন্তু আনিসুল হক ব্যতিক্রম। সেমিনারের পুরো সময়টা জুড়ে ছিলেন। শুধু তাই নয়, যারা তার অনুজ তাদের বক্তব্যও শুনেছেন গভীর মনোযোগে, শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানের।
এরপর দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার বিভিন্ন জায়গায়। আনিসুল হকের সেই ভুবন ভোলানো হাসি, স্বতফূর্ত ব্যক্তিত্ব। এক অদৃশ্য ঐন্দ্রজালিক শক্তি তার, মানুষকে কাছে টানার। তুষার ভাইয়ের কাছে কখনও কখনও আনিসুল হকের প্রশংসা শুনে বিরক্ত হতাম, বেশি বেশি মনে হতো। মনে হতো তুষার ভাই বাড়িয়ে বলছে আনিসুল হক সম্পর্কে, ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে। পরে তুষার ভাইয়ের কথার সঙ্গে মানুষটির অক্ষরে অক্ষরে মিল পেলাম।
‘সাপ্তাহিক কাগজ’ আনিসুল হককে প্রচ্ছদে এনেছিল দু’বার। মেয়র হবার আগে ও পরে। মেয়র হবার আগের সাক্ষাৎকারে তাকে যতটা আত্মবিশ্বাসী, প্রত্যয়ী, কর্মপ্রিয়, নিষ্ঠাবান মনে হয়েছিল, মেয়র হবার পর সেই মাত্রা কমেনি বরং বেড়েছিল বহুগুন। দ্বিতীয় প্রচ্ছদ ছিল ‘ঢাকার মেয়র, ঢাকার হিরো আনিসুল হক’। বর্ষীয়ান সাংবাদিকদের অনেকেই প্রচ্ছদ দেখে আমাকে বলেছিলেন, ঢাকার দু’জন মেয়র, জববার আপনি একজনকে হিরো বললেন, একটু ব্যালেন্স করা দরকার ছিল না! আমি বরাবরই কোদালকে কোদাল বলতে পছন্দ করি, আমার স্বভাবটা অমনই।
পঙ্কিল ঢাকার উত্তরকে অনেকটাই বদলে দিয়েছিলেন আনিসুল হক। ‘ঢাকা চাকা’ নামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস সেবা চালু করা, বনানী, বারিধারা, নিকেতন এলাকায় বিশেষ রংয়ের রিকশা, মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউটার্ন নির্মাণ এমন অনেক কাজ করেছেন তিনি। অনেকেই কাজ করছি, কাজ করছি বলেন, তবে তা দৃশ্যমান হয় না। আনিসুল হকের কাজ দৃশ্যমান ছিল। বিশেষ করে মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও এর মতো ট্রাক টার্মিনালগুলো দখলমুক্ত করা খুব সহজ কাজ ছিল না। এসব টার্মিনালের সঙ্গে অনেক ছোট বড় নেতার পুঁজি, বাণিজ্যের হিসেব জড়িত। উপার্জন জড়িত। আনিসুল হক ট্রাক টার্মিনালের সকল দুর্বৃত্তায়নের আগাছা, শেকড়সহ উপরে ফেলেছিলেন।
একটা ছবিতে অনেকে অভিনয় করেন। অনেকের অনেক চরিত্র। কিন্তু দায়িত্ব যে নেয়, অন্যায়ের প্রতিবাদ যে করে, লোকে তাকেই হিরো মনে করে। লোকের কাছে সেই-ই হিরো।
জীবনের ছবিটিও একই। থাকে অনেকে, দায়িত্ব সকলে নেয় না, পালন করে না। প্রতিবাদও করে না। আনিসুল হক নিজে অন্যায় করতেন না, অন্যকেও দিতেন না অন্যায় করতে। হিরোরা এমনই হয়। আনিসুল হক হিরো ছিলেন, সত্যিকারের হিরো।
ঢাকার মেয়র, ঢাকার হিরো আনিসুল হক।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
