21 C
Dhaka
সোমবার, ডিসেম্বর ১১, ২০২৩

দিলীপের পরকীয়ার যাতনা আমৃত্যু সয়েছেন সায়রা

বিশেষ সংবাদ

Juboraj Faishal
Juboraj Faishalhttps://www.nagorik.com
Juboraj Faishal is a News Room Editor of Nagorik TV.
- Advertisement -

ভারতীয় চলচ্চিত্রে হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তখনও ‘বলিউড’ হয়ে ওঠেনি। ১৯৪৪ সালের কথা। জোয়ার ভাটা ছবি দিয়ে পা রাখেন হিন্দি সিনেমায় মুহাম্মদ ইউসুফ খান, যাকে তামাম পৃথিবী চেনে দিলীপ কুমার নামে।

সিনেমার মত ব্যক্তিগত জীবনেও জোয়ার ভাঁটা কিছু কম যায়নি তার। প্রধানত তার প্রেমময় জীবনে লেগেই ছিল উথাল-পাতাল বৈরিতা।

সমস্ত চোরাবালি ভেদ করে দিলীপ কুমারের শেষ দিন পর্যন্ত নিজের করে আগলে রেখেছিলেন স্ত্রী সায়রা বানু। যদিও বছর খানেকের মত সায়রা’কে ছেড়েই পরনারীর সাথে কাটিয়েছেন দিলীপ। তবুও সায়রা আমৃত্যু থেকে গেছেন দিলীপের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে। পরম আদর যত্নে মহিরুহের মত স্নিগ্ধ শীতলতায় আগলে রেখেছেন স্বামীকে।

স্বামীকে ঠিক কতটা অর্জন করতে পারলে এভাবে ভালোবাসা যায় তার প্রকৃত উদাহরণ, এই বলিউড ডিভা সায়রা বানু। নিঃসন্তান শব্দটিকে জীবন থেকে মুছে ফেলতে ভেতরে ভেতরে অসংখ্যবার ঝলসে গেছেন তিনি। তবু সমস্ত কিছু মানিয়ে নিয়ে অবিচল থেকেছেন স্বামীর প্রতি, স্বামীকে ঘিরে নিজের ভালোবাসার প্রতি।

সায়রা জন্মেছিলেন মুসৌরিতে ১৯৪৪ সালের ২৩ আগস্ট। বলিউডের তিন ও চার দশকের বিখ্যাত নায়িকা ছিলেন, সায়রার মা নাসিমা বানু। যার রুপে নিজেই বশ হয়েছিলেন কিংবদন্তী সুরকার নওশাদ। সায়রার বাবা প্রযোজক এহসান উল হকের পরিবার ছিল খুবই অভিজাত বনেদি পরিবার। আর মায়ের পরিবারিক অবস্থান উল্লেখযোগ্য বিশেষ ছিলনা।

সায়রার দিদিমা ছিলেন চামিয়াঁ বাঈ। বিভিন্ন রাজদরবারে নৃত্যগীত পরিবেশনা করতেন। সায়রা ও ভাই সুলতানের শৈশবকালেই ঘর ভাঙে তাদের বাবা-মায়ের। এক কথায় বলা যায়, নাসিমা বানু একাধারে ছিলেন একজন সফল সিঙ্গেল মাদার এবং সে যুগের একজন সফল দাপুটে অভিনেত্রী।

বয়স ১৬ তে ‘জংলি’ ছবি দিয়ে শাম্মি কাপুরের বিপরীতে প্রথম নায়িকারূপে আত্মপ্রকাশ করে সায়রা বানু। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। দিলীপ তখন স্টার। দিলীপ সায়রাকে পিচ্চি বলেই গণ্য করতেন। কারণ দুজনের বয়সের তফাত ২২ বছর।

বলিউডি খান পরম্পরার প্রথম ‘খান’ দিলীপ কুমার। অভিনেত্রী দেবিকা রাণী সুযোগ করে দিয়েছিলেন ফিল্মে। অমিয় চক্রবর্তীর পরিচালনায় ১৯৪৪ সালে মুক্তি পেল ‘জোয়ার ভাঁটা’। দেবিকা রাণীর পরামর্শেই নাম বদলে হয়ে গেলেন ইউসুফ খান থেকে দিলীপ কুমার। বাকিটা পুরোপুরি এক জীবন্ত ইতিহাস। যা প্রায় সবারই  জানা।

বারবার দিলীপ কুমারের মন মজেছে বিভিন্ন নারীতে। ১৯৪৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শহিদ’  ছবিতে দিলীপের নায়িকা ছিলেন ‘কামিনী কৌশল’। বাস্তবেও তাদের প্রেম ছিল ইন্ডাস্ট্রিতে বহু চর্চিত বিষয়। তারা বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করলে বাধা দেয় কামিনীর দাদা। পরে কামিনী বিয়ে করেন প্রয়াত দিদির বরকে। কামিনী পর্ব চুকে গেল দিলীপের জীবন থেকে।

এবার দিলীপের সঙ্গে শুরু হলো বলিউড সুন্দরী মধুবালার তুমুল প্রেম। দীর্ঘ সাত বছরের প্রেমে এবারও ভাটা পড়ে মধুর বাবা আতাউল্লাহ খানের জন্য। এ নিয়ে আদালতে মামলা করেন আতাউল্লাহ খান। বাবার কথা মেনেই দিলীপ পর্ব শেষ করে বিয়ে করেন ডিভোর্সি কিশোর কুমারকে।

আর এদিকে ‘জংলি’ ও ‘পড়োসন’ এর নায়িকা সায়রা বানু পছন্দ করলেন নায়ক রাজেন্দ্র কুমারকে। দুজনে জুটি হয়ে ছবিও করেছেন। রাজেন্দ্রকুমার বিবাহিত হওয়ায় হস্তক্ষেপ করেন মা নাসিমা বানু। বাধ্য হয়ে সড়তে হয় রাজেন্দ্রকুমার থেকে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো মেয়ের জন্য মা নাসিমা বানুই আবার ঘটকালি করেন দিলীপ-সায়রার বিয়েতে। দিলীপকে স্বামী হিসেবে পেয়ে সায়রার মনে হয়েছিলো এবার তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন পূরণ হলো। কারণ সেই নাবালিকা বয়স থেকেই মেগাস্টার দিলীপকে ঘিরে ছিলো তার প্রচ্ছন্ন ভালোলাগা। প্রথম আলাপে দিলীপ কুমার সায়রার রূপের প্রশংসা করলেও  ‘বাচ্চা মেয়ে’ বলে দূরত্ব বজায় রাখতেন।

১৯৬৬ তে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের সময় এ দম্পতির বয়সের ব্যবধান ছিলো ২২ বছর। যখন দিলীপ ছিলেন ৪৪ বছর বয়সি স্টার।

এ বিয়ের খবর জানতে পেরে কষ্ট পেয়েছিলেন দিলীপের প্রাক্তন প্রেমিকা মধুবালা। এমনিতেই তার ছিলো হার্টের সমস্যা। সঙ্গে আবার যোগ হয়েছে এমন খবরের বৈরী হাওয়া। মাত্র ৩৬ বছর বয়সেই মারা যান মধু। সে চেয়েছিলো তার বাবার কাছে নতি স্বীকার করুক দিলীপ তাহলেই থেকে যেত সম্পর্কটা। কিন্তু দিলীপ তা করেননি।

এতজন প্রাক্তনের প্রেমিক এবং তার দ্বিগুণ বয়সীকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে কোন অসুবিধে হয়নি সায়রা বানুর। ‘এ বিয়ে বেশিদিন টিকবেনা’ বলে সে সময় পারিপার্শ্বিক নানা মুখরোচক কথা শোনা গেলেও দিলীপ-সায়রা দম্পতি কুলুপ এটে দিয়েছিলেন সেসব নিন্দুকের মুখে। দুজনের পাশে ছায়ার মত থেকে প্রায় পাঁচ দশকের বেশি দাম্পত্য জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন দিলীপ-সায়রা দম্পতি।

একবার তো বেশ বড়সড় রকমের দাম্পত্য কলহ শুরু হলো। সম্পর্ক প্রায় ভেঙেই গেল। পরে সম্পর্ক টিকে যায় শুধু স্বামীর প্রতি সায়রার আগাধ ভালোবাসা ছিলো বলে। আর তার ছিলো অগাধ ক্ষমা করার এক অসামান্য ক্ষমতা। একসময় সায়রার প্রতি শুরু হয় দিলীপের নানান অবিচার। হয়তো অন্য কোন স্ত্রী হলে তা মেনে নিতেন না। আর তাছাড়া সায়রাই বা কম কিসে? অত নামকরা একটা নায়িকা। তাছাড়া পোশাক পরিচ্ছদে যা সাহসী ছিলেন, একদম মাথা ঘুরিয়ে দিতেন।

এদিকে সায়রার মা হতে না পারাটা তাদের সম্পর্ক ভাঙনের একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়ালো। সায়রার গর্ভে দিলীপের  সন্তানও এসেছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দম্পতির। সন্তান ধারণের পর অসুস্থ হয়ে যান সায়রা। একপর্যায়ে গর্ভপাত হয়ে যায় সায়রার। চিকিৎসক বাঁচাতে পারেনি সায়রা-দিলীপের সন্তানকে। এবং চিকিৎসক জানিয়ে দেন, সায়রা যতবারই মা হবার চেষ্টা করবেন ততবার ঠিক একই ঘটনা ঘটবে। সায়রার মা হবার সম্ভাবনা কম। এ আঘাত মেনে নিতে পারেনি কিংবদন্তী দিলীপ কুমার। আর পাঁচটা স্বামীর মতই দিলীপও ভাবলেন, এই মেয়েকে বিয়ে কি লাভ হল যে তার বংশধরই দিতে পারবেনা। 

এ ঘটনার পর ভেঙে পড়েন দিলীপ। দিলীপের যখন সায়রার পাশে থাকার কথা ঠিক তখন বাড়তে থাকে দুজনের মধ্যে দুরত্ব। অন্ধ্রপ্রদেশে ক্রিকেট প্রদর্শনী ম্যাচে গিয়ে দিলীপ কুমারের আলাপ হয় তার এক পাকিস্তানি অনুরাগী আসমা’র সঙ্গে। তিন সন্তানের জননী ডিভোর্সী আসমা ছিলেন দিলীপের বোনের বান্ধবী। সন্তানের আশায় সেই আসমার প্রেমেই পড়লেন দিলীপ ওরফে ইউসুফ খান।

বাজারে গুঞ্জন আছে তিনি সায়রা বানুকে তালাক দিয়ে গাঁট বেঁধেছিলেন আসমার সঙ্গে। আসমার প্রতি দিলীপের সমস্ত প্রেম ও দুর্বলতা সায়রার থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। একটা সময় নিজের ‘পালি হিল’ এর বাংলোতে যে আসমাকে নিয়ে আসেন সহবাস করতে, সে খবর তিনি সংবাদ মাধ্যম থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন।

কিন্তু দিলীপ কুমার ফের বিয়ে করেছেন সে খবর কি চাপা থাকবার মত? খবর ছড়িয়ে পড়তেই সায়রা বানুর কানে যায়। নির্মম আঘাত পেলেন তিনি। আসমাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাতে বলেন সায়রা।

আসমা রেহমানের সঙ্গে দিলীপ কুমারের এ প্রণয়মাখা বন্ধন টেকেনি বেশিদিন। কারণ আসমার আচরণ মেনে নেবার মত ছিলোনা। কথায় কথায় অপমান করতেন দিলীপকে। তার ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে দু বছরের মাথায় আসমাকে তালাক দিয়ে দিলীপ ফেরেন সেই সায়রার কাছেই।

আসমাও আবার বিয়ে করে ঘরে ওঠেন প্রথম স্বামীর সাথেই। দুজনেই দ্বিতীয় সম্পর্কে জড়িয়ে ভুল বুঝতে পেরে ফেরেন সেই প্রথম সংসারে।

সায়রার যায়গায় অন্য কেউ হলে এ অপমানের সম্পর্ক কখনোই মেনে নিতোনা। কিন্তু সেদিনও দিলীপ কুমারকে ফেরাননি সায়রা। আশির দশক উত্তাল তখন দিলীপময় বহুগামী জীবন চর্চার খবরে। সবকিছুকে তুচ্ছ করে সায়রা বলেছিলেন, `‘দিলীপসাব আমার জীবনের কোহিনূর’।

সায়রা-দিলীপের ১৬ বছরের নিঃসন্তান সংসার। সন্তানের আশায় আসমার সঙ্গে জড়িয়ে আবার সায়রার কাছেই তাকে ফিরতে হয়েছে। দিলীপসাব বলেছিলেন আসমার সঙ্গে জড়ানোটা এক বিশাল ভুল ছিলো। দুদণ্ড শান্তির আশায় ফেরেন সায়রার কাছেই।

দিলীপ ফেরার পর থেকেই অভিনয় ক্যারিয়ার ছেড়ে দেন সায়রা। তার যুক্তি ছিলো বাইরে সময় দিয়ে আর কোনভাবেই তিনি স্বামীকে হারাতে চাননা। এরপর তাদের নতুন করে বিয়ে হয়। বাসর হয়। এক শান্তিময় দাম্পত্য জীবন চলতে থাকে দুজনের। স্বামীকে সময় না দিলে হয়তো এভাবে নিজের করে পেতোনা কখনোই। দিলীপ স্বীকার করেছিলেন সায়রার সাহচর্য ছাড়া তাঁর অভিনয়ের সেকেন্ড ইনিংস চলতোনা।

বয়সে ২২ বছরের বড় স্বামীর দুঃসময়ও একাই সামলেছেন সায়রা। দিলীপকে সন্তান দিতে না পারার অক্ষমতাই যেন সেবা দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন সায়রা। একজন হার্টথ্রব নায়িকা হয়েও তার সহ্যশক্তি ছিলো সাধারন নারীদের মতই। কম পরস্ত্রীকাতর ছিলেন না তার স্বামী। সেসব না ভেবে শতায়ু দিলীপ কুমারকে যেভাবে ভালোবাসা আর সেবা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন সায়রা, ইতিহাসে তা উদাহরণ হয়ে থাকবে।

আশা পারেখ, হেলেন, ওয়াহিদা রহমান, সাধনারা সায়য়ার বান্ধবী। ৯৭ বছর বয়সী দিলীপ কুমারকে একা পড়ে থাকতে হবে বলে সবাই ট্রাভেল ট্যুরে গেলেও যেতেন না সায়রা। পাকাপোক্তভাবে স্বামীর সেবা করেছেন প্রতিটি মুহুর্তজুড়ে।

‘ভালোবাসা থেকেই আমি দিলীপ সাহেবের দেখাশোনা করি। কারও প্রশংসা কুড়োতে এসব করিনা। আমি চাইনা কেউ আমাকে স্বামী-অন্তপ্রাণ স্ত্রী হিসেবে দেখুক বা বলুক। তাকে স্পর্শ করা, তাকে আদর-যত্ন করাটা আমার কাছে দুনিয়ার সেরা প্রাপ্তি। আমি তাকে ভালোবাসি, তিনি আমার প্রাণ’ বলেছিলেন সায়রা।

সায়রা বারবার দিলীপ কুমারকে ক্ষমা করেছেন। ভালোবাসা থেকেই এই ক্ষমা। নিজের কাছে নিজেই শান্তি পেয়েছেন। এখানেই তার মহত্ব।

ফারদিন সানি/ফই

- Advertisement -
- Advertisement -

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বাধিক পঠিত