
শুভ কিবরিয়া
সম্প্রতি শেষ হয়েছে নেপালের জাতীয় নির্বাচন। সর্বশেষ পাওয়া ফলাফলে এই নির্বাচনে বামপন্থী জোট ব্যাপক সাফল্য লাভ করেছে। সাবেক মাওবাদী বিদ্রোহী এবং কমিউনিস্ট দল জোট করে এই নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে। কমিউনিষ্ট পার্টি অফ নেপাল (ইউনাইটেড মার্কসিষ্ট-লেনিনিষ্ট) এবং দ্য কমিউনিষ্ট পার্টি অফ নেপাল (মাওয়িষ্ট সেন্টার)সহ অন্যান্য বামপন্থী দলের এই জোট ১১৬টি আসনে জয়লাভ করেছে। অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক জোট পেয়েছে মাত্র ২৩ টি আসন।
৭টি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের ৬টিতেই জিতেছে বামপন্থী এই জোট। অন্যটিতে জিতেছে স্থানীয় দলগুলো। ভারত সীমান্তবর্তী এই একটি প্রদেশে সরকার গঠন করবে স্থানীয় দলগুলো। এই প্রদেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার হলো মাধেসি সম্প্রদায়ের মানুষ। মাধেসি সম্প্রদায়ের ভোটাররা বামজোটকেও ভোট দেয়নি, নেপালী কংগ্রেসকেও ভোট দেয়নি।
নেপালের তরাই তথা সমতলভূমির মাধেসি জাতিসত্তার মানুষ দেশটির মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে স্বায়ত্তশাসন ও বাড়তি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করছে অনেকদিন ধরেই। মূলধারার পাহাড়ি নেপালিদের সাথে এ নিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত আছে মাধেসি সম্প্রদায়।
উল্লেখ্য প্রথম দফায় গত ২৬ নভেম্বর এবং দ্বিতীয় দফায় ৭ ডিসেম্বর নেপালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটের ভিত্তিতে ১৬৫টি আসনের ফলাফল নির্ধারিত হবে। বাকি ১১০টি আসন নির্ধারিত হবে ভোটের আনুপাতিক হারে।
দুই.
১৯৯৬ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত টানা লড়াই চালিয়ে গেছে নেপালের মাওবাদীরা। পরে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি শান্তিচুক্তিতে রাজি হয় তারা। প্রায় আড়াইশো বছরের রাজতন্ত্র শেষে ২০০৬ সালে গৃহযুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসে নেপাল। এর দুই বছর পর রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে। ২০০৮-এর পরে ২০১৩- তে ভোট দেয় নেপালিরা। তবে সেটা ছিল সাংবিধানিক পরিষদের ভোট। যার ভিত্তিতেই ২০১৫- তে নতুন করে লেখা হয় ‘ফেডারেল ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব নেপাল’-এর সংবিধান। এবার সেই সংবিধান মেনেই নির্বাচিত সরকার গঠনের পথে রয়েছে নেপাল।
উল্লেখ্য গত নয় বছরে নেপালে প্রধানমন্ত্রী পদে রদবদল হয়েছে ১০ বার। এই নির্বাচনকে তাই গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা হিসেবে মনে করা হচ্ছে।
দুটি শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের মাঝে নেপাল অনেকটা বাফার স্টেট। ফলে নেপালের রাজনীতিতে চীন ও ভারতের ব্যাপক প্রভাব আছে। এ নির্বাচনে বামপন্থীদের জোটকে বলা হচ্ছে চীনঘেঁষা। আর কংগ্রেসকে ভারতপন্থী। সেই হিসাবে বলা যায় নেপালের এবারের নির্বাচনে ভারতপন্থীদের পরাজয় ও চীনঘেঁষা রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটেছে।
নেপালের নির্বাচনের বিশেষ দিক হচ্ছে মাওবাদী ও নেপালি মার্কসবাদী- লেনিনপন্থীদের ঐক্য। জাতীয় প্রয়োজনেই নেপালের বামদলগুলো ঐক্য করেছে বলে তাদের দাবি। নিজস্ব রাজনৈতিক মতানৈক্যকে অতিক্রম করে স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের বিষয়গুলোকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে বলে দাবি বাম জোটের। ভোটাররা তাদের প্রতি আস্থা রেখেছে।
তিন.
নেপালের এই নির্বাচনের কতগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য অ্যাছে। যেমন:-
০১. এ নির্বাচন রাতারাতি নেপালের সবকিছু বদলে দেবে না। তবে বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিনের রাজতন্ত্র, গৃহযুদ্ধের পর এই নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি দুই ক্ষেত্রেই নেপালের নতুন দিনের সূচনা করতে পারে। নেপালের ভোটাররা নতুন দিনের প্রত্যাশাতেই ভোট দিয়েছেন।
০২. নেপালের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব দারুণ। নেপালের রাজনীতির বড় অংশ ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকতে চেয়েছে অতীতেও। এবারও ভোটের রাজনীতিতে সেই প্রভাব দেখা যাচ্ছে। ভারতপন্থী বলে পরিচিত নেপাল কংগ্রেসকে একরকম প্রত্যাখান করেছে নেপালের ভোটারদের বড় অংশ। এবারের নির্বাচনে সেটা একটা বড় ঘটনা।
০৩. বামপন্থীদের ঐক্য নেপালের নির্বাচনের আলোচিত ঘটনা। দেশে দেশে যখন বামপন্থীরা নানা বিভেদে অনৈক্যের ভেলায় চড়ে খন্ড-বিখন্ড হচ্ছে তখন নেপালে মাওবাদী আর মার্কসবাদীদের অভূতপূর্ব ভোটের ঐক্য এক নতুন ঘটনা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের তো বটেই এশিয়ার বিভিন্ন দেশের বামপন্থীদের জন্য নেপাল-মডেল নতুন ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
চার.
এই নির্বাচনের ফলে যে সরকার গঠিত হচ্ছে তার সামনে আছে বহুবিধ চ্যালেঞ্জ:-
০১. জনগণের প্রত্যাশার বিপুল চাপ থাকবে নতুন সরকারের প্রতি। প্রথমত, জনগণ চাইবে একটি স্থায়ী সরকার। যে সরকার কোনরকম বিরতি ছাড়াই তার নির্দিষ্ট মেয়াদ পূরণ করবে। নেপালের অর্থনীতি ভঙ্গুর। সেই অর্থনীতির গতিময়তা চাইবে জনগণ। নেপালে দুর্নীতিও ব্যাপক। জনগণের জীবনকে সহনীয় করতে দুর্নীতি কমানোর বাস্তব পদক্ষেপ নেবার চাপ থাকবে সরকারের প্রতি।
০২. ভারতপন্থী আর চীনপন্থী এই অভিধার বাইরের গিয়ে জনগণ চাইবে ‘নেপালপন্থী’ সরকার। যে সরকার নেপালের সকল সমস্যার সমাধান করবে। বিশেষত চীন ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে নেপালের নিজস্ব স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করবে।
০৩. নতুন সরকারের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নেপালের নতুন সংবিধান বাস্তবায়ন। জনপ্রত্যাশা হচ্ছে, এই নতুন সংবিধানের মাধ্যমে নেপাল একটি ধর্মনিরপেক্ষ, জনমুখী রাষ্ট্রে পরিণত হবে।
০৪. নেপালে পাহাড়ি আর সমতলের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন আছে। নেপালের রাজনীতিতে পাহাড়িরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। অন্যদিকে তরাই অঞ্চলের সমতলের মাধেসি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বঞ্চনার অনুভূতি আছে। এক দেশের মধ্যে দুই ভিন্ন মনোভাবকে জাতীয় স্বার্থে এক করার কঠিন কাজটি করতে হবে নতুন সরকারকে।
পাঁচ.
নেপালের রাজনীতি বহু কঠিন পথ অতিক্রম করেছে। বহু ঝড়োপথ পেরিয়ে গণতন্ত্রের নতুন পথে এসে দাড়িয়েছে নেপাল। ভারত ও চীনের প্রভাব বলয় এড়িয়ে একটি স্বাধীন রাজনীতি যেমন প্রতিষ্ঠা করতে হবে নেপালকে তেমনি একটি জনকল্যাণমুখি অর্থনীতির দিকেও মনোযোগ দিতে হবে । ভূমিকম্পের মতো নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নেপাল। সেসব ক্ষতি পুষিয়ে জনগণের মঙ্গল নিশ্চিত করার মতো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করাই হচ্ছে নেপালের নতুন সরকারের বড় কাজ। অন্যদিকে ভারত, চীনের বাইরে সার্ক অঞ্চলের অন্যান্য দেশের সাথেও সম্পর্ক বিনির্মাণের কাজটি করতে হবে নেপালের নতুন সরকারকে।
যে কোন বামপন্থী সরকারের কাছে আমজনতার প্রত্যাশা থাকে অনেক বেশি। নেপালের নতুন সরকার গঠন করতে যাওয়া বাম জোটের সরকারও তার ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু নেপালের নতুন সরকার কি সেসব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে? একটা পুজিঁবাদি কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে বামভাবনা বাস্তবায়ন করা আদোতেই কতটা সম্ভব? পৃথিবীর অনেক দেশে বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকা অঞ্চলে বামপন্থীরা অনেক রাষ্ট্রে বিজয়লাভ করলেও বাম-আদর্শায়িত অর্থনীতির দেখা মেলেনি। আদোতেই সেটা সম্ভব কি না তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার প্রভাব, মুক্তবাণিজ্যের প্রভাব এড়িয়ে একটা বাম-ভাবাপন্ন অর্থনীতি তৈরি করা যে সম্ভব , সেই সত্যটা আজকের পৃথিবীতে খুব বাস্তব হয়ে ওঠেনি। এ সত্য মাথায় নিয়ে, এরকম বহুবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেপালের নতুন বামজোট সরকার কতটা সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
শুভ কিবরিয়া: সাংবাদিক
//শাফে
