
শুভ কিবরিয়া
সরাইলের সারমেয়
একদিন গণভবনের সান্ধ্য আসর বেশ জমে উঠেছে। এমন সময় উত্তেজিত তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এসে উপস্থিত, ‘নেতা, এই যে গাফফার কী লিখেছে আমার সম্পর্কে দেখেছেন? লিখেছে, আমি নাকি সরাইলের কুকুর।’
বঙ্গবন্ধু জানতে চাইলেন, কেসটি কী? যা জানা গেল, তা হলো, গাফফার তখন মন্ত্রী কামরুজ্জামান হেনা ভাইয়ের সদ্য প্রকাশিত দৈনিক জনপদ-এর সম্পাদক। তাহের ঠাকুর সেই পত্রিকার সরকারি বিজ্ঞাপন কমিয়ে দেওয়ায় আবদুল গাফফার চৌধুরী তথ্য মন্ত্রণালয়ের কড়া সমালোচনায় প্রতিমন্ত্রীকে ‘সরাইলের সারমেয়’ লিখেছিলেন। সরাইলের কুকুরকে তখন বিলেতি অ্যালসেসিয়ানের পর্যায়ের দুর্ধর্ষ মনে করা হতো। প্রতিমন্ত্রী ঠাকুরের আদি বাড়ি সেই এলাকায়।
ঠাকুরের নালিশ শুনেই গম্ভীর হয়ে গেলেন মুজিব ভাই। গাফফারের দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বললেন, ‘অন্যায় করেছ! তাহেরকে সবাইলের কুকুর বলা ঠিক হয়নি। জানো, কত প্রজাতির কুকুর আছে? তারপর বলতে শুরু করলেন, বিলেতি মেমসাহেবরা কোলে বসিয়ে ল্যাপডগকে আদর করেন। অষ্ট্রেলিয়ায় রাখালেরা তাদের ভেড়ার পাল সামলায় শেফার্ড কুকুর লেলিয়ে দিয়ে। বিলেতের অভিজাত জমিদার ডিউকেরা বছরে একবার শিয়াল শিকারে বের হয়। প্রথমে জঙ্গলে ছেড়ে দেয় হান্টিং ডগ। সেই সব ভয়ংকর-দর্শন কুকুর শিয়ালদের তাড়া করে। তাদের পেছনে ঘোড়ার পিঠে থাকে শিকারিরা। ইউরোপে অ্যালসেসিয়ান কুকুর বাড়ি পাহারা দেয়। দুর্ধর্ষ এসব অ্যালসেসিয়ান অনেকটা সরাইলের কুকুরের মতো দেখতে, পাতলা লম্বা ভয়ংকর-দর্শন।’
তারপর গাফফারকে বলেলেন ‘আমার ভজহরির মতো এখন ঘাড়ে-গর্দানে নাদুসনুদুস, ফরসা তবে হ্যাঁ রাগলে লালমুখো হয়ে যায়, একধরনের কুকুরও আছে বৈকি। সেগুলো হলো বুলডগ লালমুখো, মোটাতাজা শরীর।’
আড় চোখে সুদর্শন নাদুসনুদুস তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে থেমে গিয়ে দুষ্টুমি ভরা গলায় বললেন, ‘গাফফার খবরদার এরপর কারও চেহারা-সুরত নিয়ে ঠাট্টা করবা না।’
কথাগুলো বলেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর মুখে ঠেকানো পাইপটির তামাকে আগুন দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমরা হাসি লুকানোর জন্য মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মুখ তুলো দেখি, লালমখো ঠাকুরমশাই ততক্ষণে উধাও।
এই ঘটনাটি লিখেছেন প্রয়াত সাংবাদিক এ বি এম মূসা তাঁর ‘মুজিব ভাই’ গ্রন্থে।
ভাল শিক্ষক, মন্দ-প্রশাসক
শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগলেন, আমি আঁতকে উঠলাম। বললাম, প্রশাসনিক কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বুঝেছি, তুমি সিএসপিদের অসহযোগিতার ভয় করছ। তুমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসতে পারবে-আমি সে ব্যবস্থা করে দেবো।’
আমি প্রমাদ গুণলাম। বললাম, ‘আমি মাষ্টারি করে এসেছি , তা-ই করতে চাই। সচিব হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই। ও-কাজ পারবো না।’
বঙ্গবন্ধু একটু চুপ করে থাকলেন। বললেন, ‘ আমার চারপাশে চোর-ডাকাত ভিড় করে আছে। আস্থা রাখতে পারি এমন সৎ লোক চাই কাজের জন্য। তাই তোমাকে বলছি। চোরদের থেকে রেহাই পেতে চাই।’
আমি একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম। বললাম, ‘ লোকে তো তাই বলে, আপনার চারপাশে অনেক অসৎ লোক, আপনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।’
এবারে তিনি রাগ করলেন। বললেন,‘ কে বলে আমি ব্যবস্থা নেই না? কিছুদিন আগে আওয়ামী লীগের এক বিশিষ্ট মহিলা কর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তাঁর নাম করে বললেন, ‘ ওকে আমি এক্সপেল করিনি? কত কাল ধরে সে আওয়ামী লীগ করে এসেছে। তাকে যেদিন এক্সপেল করি, রাতে আমি ঠিকমত ঘুমোতে পারিনি। ওর চেহারা , ওর মা-বাপের চেহারা, ওর ভাইবোনের চেহারা বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।’
এরকম কোনো সময়ে শিক্ষামন্ত্রী উঠে পড়লেন। তিনি লন্ডন যাচ্ছেন-তাঁকে বিমানবন্দরে যেতে হবে। পরে শুনেছিলাম, লন্ডনে আমাদের দূতাবাসের কাউকে কাউকে তিনি বলেছিলেন, আমি শিক্ষা-সচিব হতে যাচ্ছি।
আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, ‘লন্ডনে গবেষণার জন্যে আমি বৃত্তি পেয়েছি। আমাকে এই কাজটি করতে দিন। ফিরে এসে আমি সরকারি কাজে যথাসাধ্য সাহায্য করবো।’
বঙ্গবন্ধু তবু বললেন, তখুনি ‘না’ ‘না’ বলে ভাববার সময় নিতে। তাঁর প্রেস সেক্রেটারি তোয়াব খানকে বলে দিলেন, পরদিন এই সময়ে আমি আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসবো-সে যেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে রাখে।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বেরিয়ে আমি সোজা এলাম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের দপ্তরে। সেখানে অর্থসচিব মতিউল ইসলাম ছিলেন। তাঁর উপস্থিতিতে আমি তাজউদ্দীনকে আদ্যোপান্ত জানালাম। অনুরোধ করলাম তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।
তাজউদ্দীন বললেন, তিনি সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাবেন। কথাচ্ছলে বঙ্গবন্ধু যদি বিষয়টা উল্লেখ করেন, তাহলে তিনি হয়তো তাঁকে নিরস্ত করতে পারবেন। তবে কথা না তুললে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তিনি কিছু বলবেন না। অবশ্য বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কথা তোলার সম্ভাবনাই বেশি।
সত্যি তা-ই হয়েছিল। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আমাকে শিক্ষা-সচিব করলে একজন ভাল শিক্ষক হারিয়ে মন্দ প্রশাসক পাওয়া যাবে-তাতে লাভ কী?
পরদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি জানতে চাইলেন, আমি মত পাল্টেছি কি না। আমি হাসলাম। বললাম, ‘ লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সুযোগটা ছাড়তে চাই না। আপনি যদি অনুমতি দেন।’
তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে। তবে কথা দিয়ে যাও, ফিরে এসে চট্টগ্রামে যাওয়ার আগে আমার সঙ্গে দেখা করে যাবে। তখন আমি যা বলব, তা কিন্তু শুনতে হবে।’
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। যা কখনো করিনি এরপর তাই করলাম।
বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম।
তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,‘ বিদেশ থেকে ফিরেই দেখা করবে আমার সঙ্গে।’ তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘ততদিনে আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখবে কি না , কে জানে?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। কিন্তু তিনি গলা এত নামিয়ে স্বগতোক্তির মতো কথাটা বলেছিলেন। তাই আর কিছু বলতে চাইলাম না। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।
সেই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা।
বঙ্গবন্ধুর সাথে এই ব্যাক্তিগত স্মৃতির কথা লিখেছেন শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান তাঁর ‘বিপুলা পৃথিবী’ গ্রন্থে।
মূসার ছেলেকে দেখতে যাব
বঙ্গবন্ধু সিরাজ ভাইয়ের (বিখ্যাত আইনজীবি প্রয়াত সিরাজুল হক) বাড়িতে কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর বললেন, ‘পাশেই কোথায় যেন মূসা থাকে। তার বাড়িতে যেতে হবে। তার ছেলেকে দেখব বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম।’ প্রতিশ্রুতির পাশ্চাৎপটটি বলতে হয়।
আগরতলা মামলা চলাকালে আমার ছেলের জন্ম হয়। পাকিস্তান অবজারভার-এর জন্য মামলার রির্পোট সংগ্রহে আদালতে অন্যদের মধ্যে রিপোর্টার আবদুর রহিমকেও পাঠাতাম।
রহিমকে বললাম, ‘নেতাকে বলো আমার একটি ছেলে হয়েছে। তিনি যেন দোয়া করেন।’
বঙ্গবন্ধু বললেন ‘মূসার ছেলেকে দেখতে যাব।’
বার্তাটি পেয়ে অবাক হয়ে বললাম, কদিন পর যিনি নিশ্চিত ফাঁসির দড়িতে ঝুলবেন বলে আমরা নিশ্চিত ছিলাম, সেই তিনি শিগগিরই আমার বাড়িতে আসবেন, বলেন কী?
সেই কথাটি ভুলেই গিয়েছিলাম, টেলিফোন পেয়ে মনে পড়ল।
সিরাজ ভাবি টেলিফোনে আমার স্ত্রীকে বললেন, ‘মুজিব ভাই আপনার বাডিতে যাচ্ছেন।’
তিনি আমার কর্মস্থল পাকিস্তান অবজারভার-এ ফোন করলেন, ‘জলদি আসো শেখ সাহেব আসছেন।’
গাড়িতে অতি দ্রুত বাড়ি এসে পৌঁছালাম। ইতিমধ্যে মুজিব ভাইকে নিয়ে আমার বাড়িতে এলেন কিশোর শ্যানন ওরফে আনিসুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রী), যে পরবর্তীকালে পিতার অসমাপ্ত কর্তব্য বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করেছিল। আমার বাড়িতে এসে মুজিব ভাই আমার ছেলেকে কোলে নিয়ে তার গলায় একটি সোনার চেইন পরিয়ে দিলে বললেন, ‘তোমার ভাবি দিয়েছে।’ একটি বেবিস্যুট, তখন বলা হতো ‘বাবা-স্যুট’, আর এক বাক্স মিষ্টি দিলেন আমরা স্ত্রীর হাতে। আমাকে দেখেই কৌতুক করে বললেন, ‘কি রে, এলাম তো! জানি যখন আসব বলেছিলাম তখন তো বিশ্বাস করিসনি, এখন নিশ্চয়ই অবাক হয়েছিস।’ অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে তাঁর অসামান্য স্মরণশক্তি ছিল- এই তুচ্ছ বিষয় মনে রেখে ছিলেন বলে।
প্রয়াত সাংবাদিক এ বি এম মূসার বয়ানে পাওয়া এই ঘটনা বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় স্মৃতিশক্তির একটি উদাহরণও বটে।
যে সংগ্রাম আর রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ঠেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কাংখিত লক্ষ্যে পৌঁছেছিল বঙ্গবন্ধুর জীবন , তাঁর পেছনে ছিল মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালবাসার শক্তি। উল্লেখিত ঘটনাগুলোয় তাঁর প্রমাণ আছে। এইসব টুকরো টুকরো ঘটনা প্রমাণ করে বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন।
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুর গল্প ৩…
বঙ্গবন্ধুর গল্প ২…
বঙ্গবন্ধুর গল্প ১…
শুকি//
