
কথা ও কাজ দুটো এক হয় খুব কম সময়ই। বেশির ভাগ সময়ই কাজের সঙ্গে কথার, কথার সঙ্গে কাজের সমন্বয় ঘটে না। কেননা, বলা যত সহজ, করা তত সহজ হয়ে উঠে না সব সময়। কিন্তু কেউ যদি নৈতিকতায়, মানবিকতায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন, তিনি তখন তা করে দেখতে পারেন। উদাহরণ হতে পারেন, কথা ও কাজের সমন্বয়ের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত নয়, নিশ্চিতই বলছি, তিনি সেই মানুষ, যিনি বরাবরই কথা ও কাজের সমন্বয় ঘটান। ঘটাতে পারেন। ঘটাতে চান বলেই সমন্বয় হয়ে উঠে তার কথা ও কাজে। অন্য দেশের নির্যাতিত, বিপদগ্রস্থ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তিনি যে অবস্থান নিয়েছেন, সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সহায়তা করছে তার সরকার, তাতে তাকে কথা ও কাজের সমন্বয়ের মানুষ না বললে নেহাত অন্যায় হবে।
যে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ‘পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি’ হিসাবে আখ্যা দিয়েছিল, সেই জাতিসংঘের এই বরবর্তা শুরুর দিকের আচরণ, সত্যিই অবাক ও বিস্মিত করার মত ছিল। গুতেরেসের নির্লিপ্ততা, দিবানিন্দ্রা সত্যিই বিস্ময়কর। অবশ্য বিস্মিতই বা হচ্ছি কেন, জাতিসংঘে জাতিসমূহের প্রতিনিধিত্ব কোথায়? একে তো জাতিসংঘ না বলে ‘রাষ্ট্রসংঘ’ বলাই ভালো। তবু ভালো, অনেক দেরি হলেও খানিক টনক নড়েছে জাতিসংঘের।
সু চিকে অসভ্য, মিয়ানমারকে আদিম, বর্বর, ব্যর্থ রাষ্ট্র বলতে বাধ্য হচ্ছি। আরাকানের একমাত্র ভূমিপুত্র জাতি রোহিঙ্গারাই, এটাই ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ১০৪৪ সালে কট্টরপন্থি বৌদ্ধ বর্মী রাজা আনাত্তহতা আরাকান দখলের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে, স্থাপন করে বৌদ্ধ বসতি। মূলত রাখাইনে দুটি জাতি গোষ্ঠির বসবাস। দক্ষিণে বার্মা বংশোদ্ভূত ‘মগ’ আর উত্তরে ভারতীয় বংশোদ্ভুত ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী, তবে তাদের দুস্কৃতি ও দস্যুবৃত্তির জন্য ‘মগের মুল্লুক’ শব্দটির প্রচলন এখান থেকেই শুরু।
জানা যায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখলের পর চরম বৌদ্ধ-আধিপত্য কায়েম হতে থাকে। এ রাজ্য ব্রিটিশদেরও দখলে আসে। ব্রিটিশ শাসনামলে প্রণীত সমগ্র মিয়ানমারের একটি জাতিতাত্ত্বিক তালিকা প্রস্তুত হলে সেখানে ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় লিপিবদ্ধ হয়। ব্রিটিশ বর্ণিত ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রোহিঙ্গা শব্দটি বাদ পড়ে। ফলে ‘ভূমিপুত্র’ হয়েও তারা পরিণত হয় ‘বিদেশি’ অভিধায়। রোহিঙ্গাদের সেই আর্তনাদ আজও বাংলাদেশের জল হাওয়াকে ভারি করে তুলছে।
মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৮ সালে। রোহিঙ্গাদের জনপ্রতিনিধিও পার্লামেন্টে ছিল সেসময়। কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন প্রবর্তনের ফলে মিয়ানমারের ইতিহাস ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। শুরু হয় রোহিঙ্গাদের জীবনে অনিমেষ ট্র্যাজেডি। সামরিক জান্তা সরকার রোহিঙ্গদেরকে ‘বিদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং পরে তাদের নাগরিক অধিকার হরণ করে নেয়। মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা যায় বেড়ে। প্রকাশ্যে নামাজেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।
বরাবরই মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি। কারণ, মাসিকে তো মা হতে হয় না। মায়ের দায়িত্ব পালন করতে হয় না। শেখ হাসিনা নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভাঙাচোড়া মানুষের মা হয়েছেন। তিনি ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’। তিনি তাই নির্যাতিত, অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ান, মায়াকান্না দেখান না। তুরস্কের ফাস্টলেডি এমিনে এরদোগান এসেছিলেন, তার কান্না দেখে মায়াকান্নার কথাই মনে পড়ে। অতই যদি প্রেম তো জাহাজে তুলে ১ লাখ রোহিঙ্গাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন না কেন? মুখে ‘মুসলিম রোহিঙ্গা’ ‘মুসলিম রোহিঙ্গা’ বলে ফেনা তুললেও আদতে, নেপথ্যে রাজনীতির খেলা, লাভলোভ, যোগবিয়োগই কাজ করে। তুরস্ক যে সিরিয়ান রিফিউজিদের আশ্রয় দেয় সেখানও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। ভারত যে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীদের সহায়তা দিয়েছিল রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল সেখানেও। কিন্তু মিয়ানমার থেকে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের যে আশ্রয় দিয়েছে তাতে বাংলাদেশের কোন স্বার্থ নেই।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে খেলতে চাইছেন অনেকেই। বিদেশি মোড়ল থেকে শুরু করে দেশীয় ঘরের বানরেরা, অনেকেই। এদের না আছে মানবিকতা, না আছে ধর্ম।
আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি) নামক সংগঠনটির কথা শোনা গেলেও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। আরসা’র আতাউল্লাহকে যারা রোহিঙ্গাদের মুক্তির নেতা বলে প্রচার করতে, বিভ্রান্তি ছড়াতে চাইছেন, বোঝা উচিত তাদের পাকিস্তানি নেতা দিয়ে রোহিঙ্গারা স্বাধীন হয় কি করে। নেতাতো সব সময় হতে হয়, নিজেদের মাটি ও মানুষের। এই আতাউল্লাহ’রা পশ্চিমের ‘পেইড পাপেট’। আরেক বিন লাদেন ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পাপেট দিয়ে, কেনা পুতুল দিয়ে আর যাই হোক, মুক্তি আসে না কখনও।
রাষ্ট্র একটি মানবিক ধারণা। নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, হত্যা, খুন, ধর্ষণ কখনও রাষ্ট্র চরিত্র হতে পারে না। রাষ্ট্র ক্রমেই রাষ্ট্রহীনতার দিকে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী রাষ্ট্রকোষের ভাঙন শুরু হয়েছে। মিয়ানমার ম্যাকায়াভেলি বা গ্রামসির সুমহান ধারণায় এখন আর রাষ্ট্র নয়। এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বাইরে স্বৈরতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র থাকা অবস্থায় কোন সীমান্ত অধ্যুষিত অঞ্চলকেও রাষ্ট্র বলা যাবে না। শুধু তাই নয়, অস্ত্রকে পণ্যতুল্য করে যে রাষ্ট্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটায় সেও রাষ্ট্র নয়। রাষ্ট্র এক বিশাল সুমহান ধারণা, নৈতিকতার চূড়ান্ত বাস্তবতা।
অন্যরা যখন যার যার মত দায় এড়াতে চাইছে, রাজনৈতিক সুবিধা নিতে মরিয়া মানবিকতার ছায়া না মাড়িয়ে, সেখানে বাংলাদেশ নির্যাতিত, নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে পেরে গর্বিত।
আমি গর্বিত বাংলাদেশের মত একটি সুমহান, মানবিক রাষ্ট্রের সন্তান হতে পেরে, নাগরিক হতে পেরে।
লেখক : সম্পাদক, আজ সারাবেলা। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, মিডিয়াওয়াচ। পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন। সদস্য, ফেমিনিস্ট ডটকম, যুক্তরাষ্ট্র।
