25 C
Dhaka
শুক্রবার, মার্চ ২৪, ২০২৩

ভাই… একবার টেক্সট করেন। একটা ফোন করেন। একবার আপনার গলাটা শুনি…

বিশেষ সংবাদ

Rabi Shankar Das
Rabi Shankar Dashttp://www.nagorik.com
Rabi Shankar Das is a Social Media Expert, Writer & Digital Journalist. He is working in Bangladesh's Entertainment & News Media industry since 2018. Currently, he is the "In-Charge Of Online" at Nagorik Television.
- Advertisement -

আনিস ভাইয়ের সাথে আমার আলাপ ১৯৮৫ সালে। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। তিনি মাঝে মাঝে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কাছে আসতেন। আড্ডা দিতেন। ষোল বছরের কিশোর আমি তখন।

একদিন আনোয়ারুল ইসলাম , কেন্দ্রের সমন্বয়কারী আমাকে বললেন , আনিসুল হকের সাথে দেখা করতে। স্যারও বললেন। আনিস ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তিনি বললেন গোটা ত্রিশেক আমার বয়সী তরুন তরুনীর সাথে তিনি আড্ডা দিতে চান। একটা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের কথা তিনি ভাবছেন। তার একটা বড় কর্মী দল বানাতে হবে।

তিনি আমাকে কেন্দ্রের পিকনিকে নানা বিষয়ে স্বভাবসুলভ সর্দারী করতে দেখেছেন। তার মনে হয়েছে আমাকে দিয়ে হবে। আমরা সব একত্রিত হলাম এলিফ্যান্ট রোড ভোজ্য তেল কলের উল্টো দিকে দোতলাতে এক চাইনীজ রেস্তোরাঁয়।

তিনি এলেন। খুব উচ্চকন্ঠে হাসলেন। তখন তিনি ভীষন জনপ্রিয় টেলিভিশন উপস্থাপক। খাওয়া শেষে তিনি সবার সাথে নানা রকম মজার গল্প করলেন। তারপর চলে যাওয়ার আগে আমার বাহুতে চাপ দিয়ে বললেন, তুমি আমার অফিসে আসবে।

অফিসে গেলাম।আমার এক আত্মীয় হাবিব ভাই তখন তার বন্ধু ও অংশীদার। তার সাথেও দেখা হত। কিন্তু অফিসে ঢুকলে মনে হত সবকিছু আনিস ভাইয়ের। পুরো অফিস তাকে দিয়ে আলো হয়ে থাকত। তিনি বললেন, সবার মধ্যে তোমাকে ছাড়া আর কেউ টেলিভিশন বোঝে বলে মনে হল না। তুমি আর আমি মিলে অনুষ্ঠান বানিয়ে ফেলব। তিনি আমাকে অনেক গুলি কলম আর খাতা কিনতে বললেন আর প্রতি সপ্তাহে একবার তার সাথে বসতে হবে এই মর্মে অনুরোধ করলেন। এজন্য যাতায়াত খরচ তিনি দেবেন বলে ঠিক করলেন। আমি নিতে রাজী হলাম না। জোর করে তিনি আমাকে বাধ্য করলেন। পকেটের পয়সা খরচ করতে হলে আমি নাকি আসব না। ঐ একবার আমি তার কাছ থেকে যাতায়াত ভাতা নিয়েছিলাম। সেটার হিসাব তাকে দিতে চাওয়ায় তিনি হো হো করে হেসে বলেছিলেন, কোক খেয়ে নিও ।

তখন মতিঝিল যেতে তিনটাকা বাসভাড়া লাগত। আমি বাসে মতিঝিল যেতাম আর তার গাড়ীতে চড়ে নানা জায়গায় ঘুরতাম। গাড়ীতেই তার সাথে আলাপ চলত।

শেষমেষ অনুষ্ঠান আর হলো না। তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু আমাদের মধ্যে বড়ভাই ছোটভাই সম্পর্ক হয়ে গেল।

তিনি বড় থেকে আরো বড় মানুষ , বড় ব্যবসায়ী হতে শুরু করলেন।

এরপর আনিস ভাই বহুদিন টেলিভিশনে যান নাই। কিন্তু আমাদের যাতায়াত চলছে। বহুদিন পরে তিনি বলা না বলা নামে ছয় পর্বের একটি ছোট অনুষ্ঠান করলেন। আর বানালেন ঈদের আনন্দমেলা। আমি ততদিনে মেডিকেল কলেজে ভর্তী হয়ে গেছি। দেশজুড়ে তার্কিক হিসেবে নাম ডাকও হয়ে গেছে।

সব অনুষ্ঠানে আমি তার সহচর। মজার ব্যাপার হলো এসবের জন্য টেলিভিশন থেকে কোন চেক নিতাম না। তার কাছ থেকেও কোন আর্থিক সহায়তা না। আমার পারিশ্রমিক হলো তার বাসায় আড্ডা আর খাওয়া দাওয়া। মাঝে মাঝে তার গাড়ীতে করে ঘুরে বেড়ানো। গভীর রাতে তিনি আমাকে আমার বাসায় নিজে ড্রাইভ করে দিয়ে যেতেন।

রুবানা আপা আমার বোন হয়ে গেছেন। আমি আনিস ভাইয়ের ছোট ভাই আর শ্যালক দুটোই।

আমি ছয় ফুট চার নাভিদকে কোলে নিয়েছি। ওয়ামিক, তানিশা, শারাফ সবাই আমার কোলে উঠেছে।

১৯৯৬ সালে তিনি তৈরী করলেন সবিনয়ে জানতে চাই নামে এক তোলপাড় করা অনুষ্ঠান। খ ম হারুনের প্রযোজনায় সেই অনুষ্ঠানে দেশের সব রাজনৈতিক দল তীক্ষ্ণ সব প্রশ্নের উত্তর দিত। আমি সেই অনুষ্ঠানের প্রধান সমন্বয়কারী। আমার কাজ হলো পুরো অনুষ্ঠান এর দেখভাল, অনুষ্ঠানের শুরুতে পর্দায় সকলকে পরিচয় করিয়ে দেয়া ও দলগুলির পরিচিতি পাঠ করা। আনিস ভাই এর উপস্থাপনা, সবাইকে এক করার অদম্য ইচ্ছা টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ক্ষমতা কত, সেটা সবাইকে বুঝিয়ে দিল।

আমি নিজেই তখন শুভেচ্ছার কারনে অতি অল্প বয়সে তারকা।অনেকে আমাকে বুদ্ধি দিল , এই অনুষ্ঠানে না যেতে। কিন্তু ভাইকে আমি কখনো, কোন কাজে না করি নাই। আমার উপরে তার অগাধ আস্থা। সেই অল্প বয়সে আমি মহা পাকনার মতো অনুষ্ঠানটার জন্য প্রশ্ন ব্যাংক তৈরী করি, দলগুলির সাথে বসে তাদের রাজী করাই , আবার তার সাথে পরিকল্পনা ঠিক করি।

আনিস ভাইয়ের সেই অনুষ্ঠান তাকে এমন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল যে তার পাশে প্রায় সবাই ম্লান হয়ে গেল। ততদিনে রুবানা হক পরিনত হয়েছেন আমার বোনে এবং আনিস ভাইয়ের বাচ্চারা আমাকে চাচা না ডেকে মামা ডাকতে শুরু করেছে।

তারপর তৈরী হল জলসা। মজার এক গানের অনুষ্ঠান। সেই অনুষ্ঠানেরও নেপথ্যে আমি কাজ করেছিলাম। যেদিন রেকর্ডিং সেদিন আমার বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা থাকায় আমি স্টেশনে যাইনি।

আনিস ভাই টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করবেন আর আমি তার সাথে নেই , এটা কখনো হয় নাই।

তিনি সবসময় বলতেন অনুষ্ঠানের চাই একটা চমৎকার শুরু আর তার চাইতেও চমৎকার একটা শেষ। বলতেন তুষার, স্টার্টিং আর এন্ডিং, এই দুটো ঠিক না হলে অনুষ্ঠান হয় না। সবচেয়ে জরুরী হল এন্ডিং। উপসংহার। আর বলতেন সিরিজ অনুষ্ঠান শেষ করতে হয় খ্যাতির মধ্যগগনে। নইলে এটা পড়বেই আর মানুষ মনে রাখবে না।

গলদঘর্ম হয়ে যেতাম ভাবতে ভাবতে। একটার পর একটা আইডিয়া নাকচ হয়ে যেত। সায়ীদ স্যার আসতেন, মমতাজউদ্দিন স্যার আসতেন, জুয়েল আইচ, আবেদ খান…তারা চলে যাবার পরেও গভীর রাত পর্যন্ত আমাদের আড্ডা চলত। আমি, আনিস ভাই আর ইকবাল ভাই। ইকবাল ভাই , আনিস ভাইয়ের বন্ধু। আমার দুজন অনেক রাতে মাঝে মাঝে হেঁটে বাড়ী ফিরতাম। তখন ঢাকা অনেক নিরাপদ ছিল।

আনিস ভাই যখন মেয়র হবেন আমি তার নির্বাচনী প্রচারনার মুখপাত্রে পরিনত হলাম। কারন আমি জানতাম তিনি কোন কাজ যেনতেন ভাবে করেন না। কথা দিলে কথা রাখেন। অর্ধেক করে ফেলে রাখেন না। কাজ আদায় করে নেন। আমি ভাবলাম এমন মানুষ মেয়র হলে উদাহরন তৈরী হবে। আরো এরকম মানুষেরা আসবেন , তরুনদের মধ্যে অনুপ্রেরণা তৈরী হবে। ঢাকা শহরের গালভরা বুলি না, চাই কাজের নেতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল আনিস ভাইকে মনোনয়ন দেয়া।

আমি আনিস ভাইকে বলতাম, আপনি জন এফ কেনেডী , আমি ববি কেনেডী। অথবা আপনি বিল ক্লিনটন , আমি স্টেফানোপুলোস।
আমি আপনার ক্যাম্পেইন ম্যানেজার।

আমি তার জন্য নানা রকম পয়েন্ট ঠিক করে রাখতাম। যেসব বিষয়ে তিনি কথা বলবেন। আমার কম্পিউটারে এরকম অনেক ফাইল আছে লেখা এ হক ১, এ হক ২, এ হক বিজিএমইএ, এ হক এফবিসিসিআই।

আমি অনেক কঠিন কঠিন কথা তাকে বলতে বলতাম, তিনি সেগুলো সাহসের সাথে বলতেন।

আর এই সব কাজের পেছনে কোয়ালিটি কন্ট্রোলার রুবানা হক। আনিস ভাই বলতেন

রুবু…. দেখো তো এটা বললে কেমন হয়?

রুবানা আপা পছন্দ না করলে সেই কথা বাদ। মাঝে মাঝে আমরা দুজন মিলে রুবানা আপাকে বোঝাতাম, যাতে কিছু জোকস বা কথা তিনি ছেড়ে দেন। রুবানা আপা মহা টিচার টাইপ। ভুল করা যাবে না। এমনকি সামান্য উচ্চারন ভুল হলেও তিনি ধরে ফেলতেন। মাঝে মাঝে আমরা দুজন রুবানা আপার মুখ দেখেই বুঝে ফেলতাম , আসিতেছে ১০ নং বিপদ সংকেত। পলিটিকাল কারেক্টনেস বলে শব্দটা আমি রুবানা আপার কাছ থেকে হাতে কলমে শিখেছি।

স্বভাব সুলভ হা হা হা করে উচ্চ কন্ঠে আনিস ভাই হাসতেন। রুবানা আপা রেগে গেলে সবার সামনে তাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে বলতেন যে, রাগ মিছরীর মতো মিষ্টি হয়ে যেত।

আনিস ভাই তার নিজের জীবনেও টিভি অনুষ্ঠানের মতো চমকে দিলেন সবাইকে।

প্রানবন্ত , বন্ধুবৎসল, কাজপাগল মানুষটি জীবনের সবটুকু নিংড়ে দিয়ে দিলেন ঢাকার মানুষকে। দেশের মানুষকে। সব সমালোচনার উত্তর তিনি দিলেন কাজ দিয়ে। দিনে ১৮ ঘন্টা কাজ। ঘুম নাই , বিশ্রাম নাই। দিন নাই, রাত নাই।

আনিস ভাই মনে করতেন হ্যাপি এন্ডিং এর চেয়ে স্যাড এন্ডিং বেশী দাগ কাটে মানুষের মনে। তিনি বলতেন মানুষ সুখের চেয়ে বেশী মনে রাখে এমন কিছু যা তার ভেতরকে স্পর্শ করে, দু:খবোধকে জাগায়, মানবিক বেদনায় আর্ত করে।

অন্তরালের শেষ অনুষ্ঠানে আনিস ভাই এক অসাধারন সমাপ্তি টেনেছিলেন। তিনি এক জনপ্রিয় রাজার কথা বলেছিলেন যিনি তার রাজ্যের মানুষের জন্য অনেক কাজ করতেন। এই জনপ্রিয় রাজা মরে যাওয়ার শত বছর পরেও মানুষ অপেক্ষা করত , রাজা ফিরে আসবেন। কিন্তু রাজা আর ফিরে আসেন নাই।

এত দরদ দিয়ে দিনি গল্পটা বলেছিলেন যে সবাই কেঁদে ফেলেছিল টেলিভিশন দেখতে দেখতে।

সেই রকম ভাবেই তিনি শেষ করে দিলেন তার জীবনের আয়োজন। ঠিক তেমন করেই মানুষ কাঁদছে এখন, ভাবছে তিনি হঠাৎ হাসতে হাসতে চলে আসবেন। বেদখল জমি উদ্ধার হবে, রাস্তা ঝকঝকে হবে, গাছ গাছালীতে সবুজ হয়ে উঠবে শহর। ফুটপাথে দাড়িয়ে থেকে বাইকারদের আটকাবেন। সাইকেল চালাবেন, ম্যারাথন দৌড়াবেন।

এই নগরীর মানুষ প্রতীক্ষায় থাকবে চিরকাল, কিন্তু তিনি আর অাসবেন না।

ভাই …

এখন আর রাস্তায় পানি উঠলে আপনাকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হতে হবে না।
বাড়ী ধ্বসে পড়লে দাঁড়িয়ে থেকে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করতে হবে না।
আগুন ধরা বাড়ীতে ঢুকে নিজেই দমকল বাহিনীর হোস হাতে নিয়ে ফেলতে হবে না।
চিকুনগুনিয়ার মশা নিয়ে ভাবতে হবে না।
সাত রাস্তার মোড়ে ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়ে অসহ্য যানজট দুরের লড়াই করতে হবে না।

আমি কোনদিন আপনার কাছে কিছু চাই নাই।
আমি তো শুধু আপনার ভাই হতে চেয়েছি।

ভাই…
একবার টেক্সট করেন।
একটা ফোন করেন।
একবার আপনার গলাটা শুনি।

আপনি আসবেন তাই আমি আর আমার দল, নাগরিক টেলিভিশনকে আপনার স্বপ্নের মতো করে তৈরী করার চেষ্টা করেছি।

আমাদের সবার টেবিলে একটা করে গাছ আছে।
আমাদের স্টেশনে পোষা প্রানী আছে।
আমাদের খেলার জায়গা আছে।
বইয়ের আর ভিডিওর , সেরা সেরা ছবির লাইব্রেরী আছে।
আমাদের স্টেশনে যে কোন জায়গায় হুইল চেয়ার নিয়ে যাওয়া যায়।
আমরা প্রয়োজনের বেশী এক পাতা কাগজ খরচ করি না।
আমাদের নিরক্ষর পিয়ন এখন পড়তে পারে, লিখতে পারে।

আপনি যা যা বলেছিলেন আপনার ইলেকশনের আগে আমরা সব করছি।

জীবনের ৩২ বছর কেটেছে আপনার আদরে, আমাকে এভাবে রেখে চলে গেলেন কেন?

একবার এসে দেখে যান…

বলেন…..
তুষার
বেটা চলে আয়….

আমরা আবার টিভি অনুষ্ঠান বানাই।

আব্দুন নূর তুষার

প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা

নাগরিক টেলিভিশন

- Advertisement -

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

সর্বাধিক পঠিত