
অন্যান্য আরব দেশের মত কুয়েতেও পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। প্রাচীন যুগ থেকে সামাজিক সংস্কৃতিতে বংশের বন্ধনটিকেযেমন তারা গুরুত্ত্ব প্রদান করে থাকে, তেমনি পরিবারের সদস্য, স্বজন, প্রতিবেশী ও বন্ধুত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্ত্ব ও সম্মানের চোখে দেখে থাকেন কুয়েতের নাগরিকগন। সামাজিক সংস্কৃতি, আচার ব্যবহার, অনুষ্ঠান, পার্বণ একসাথে উদযাপনে তাদের জুড়ি নেই। এসবকে তারা জীবনের অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ন অংশই মনে করেন।

কুয়েতিদের সামাজিক সংস্কৃতিতে বিয়ের সবচেয়ে বেশী গুরুত্ত্ববহ। প্রাচীন যুগ থেকে আরবরা বিয়েকে পারিবারিক, বংশীয় ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ়তর করা ও নিজের শক্তি, মর্যাদা ও সামাজিক অবস্থান সংহত করার উপাদান হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। যদিও স্থান, কাল ও পাত্রভেদে এ ধ্যান ধারণা অনেকাংশেই বদলেছে।
পরিবার, বংশ বা স্বজনদের মধ্যে পছন্দসই পাত্র-পাত্রী যুৎসই না হলে বা না পেলে আমাদের দেশের মত ঘটক বা ম্যাচমেকার নিয়োগ করা হয়ে থাকে। পাত্রী প্রাথমিকভাবে পছন্দ হলে পাত্রের পিতাকে সম্যক অবহিত করা হয়। পাত্রপক্ষ সম্মতি প্রদান করলে, পাত্রীপক্ষের মতামত নেন নিয়োজিত ঘটক। এরপর দু’পক্ষের সম্মতিতে পারিবারিক মিটিং এর আয়োজন করা হয় এবং আলোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী সিদ্ধান্তে গৃহীত হয়।

সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকে পাত্রীর বাড়ির বাইরে বের হওয়া কিংবা পরিবারের সদস্য ব্যতিত অন্য কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধের রেওয়াজ রয়েছে। এ সময় পাত্রের পিতা বা অভিভাবক পাত্রীকে বিয়ের জন্য উপহার সামগ্রী ক্রয়ের জন্য অর্থ প্রদান করে থাকেন। আঞ্চলিক ভাষায় এ উপহার সামগ্রীকে “ডাজা” বলা হয়ে থাকে। ডাজায় সাধারনত এক জোড়া পরিধেয় বস্ত্র, তোয়ালে, বিছানার চাদর ও কম্বল অন্তর্ভূক্ত। উপহার সামগ্রী ক্রয়ের পর পরবিবার ও স্বজনদের মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ ও সম্মানিত নারীসদস্যের একটি দল সেগুলো সপ্তাহের সোমবার অথবা বৃহস্পতিবার পাত্রীপক্ষের বাড়িতে নিয়ে যায়।
এ সময় তারা আঞ্চলিক রীতিতে বিয়ের গান গেয়ে উপহার প্রদান অনুষ্ঠানটি উদযাপন করে থাকে। রীতি অনুয়ায়ী হারিকেনের আলোয় আলেকসজ্জ্বা করতে দেখা যায়। পাত্র ও পাত্রী দু’পক্ষের নারী সদস্যগনই এ অনুষ্ঠানে অংশ নেয়। পাত্রীর পিতা বা পরিবারের পক্ষে অন্যতম মুরুব্বী এ উপহার সামগী গ্রহন করা মানেই এ বিয়েতে তাদের চূড়ান্ত মত রয়েছে। তারপর দু’পক্ষ বিয়ের আনুষ্ঠানিক কর্মযজ্ঞে হাত দেন।

বিয়ের রাতে বর তার বাড়ি থেকে পিতা, চাচা, ফুফা, মামা, নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের নিয়ে কনের বাড়িতে গমন করে। কনের বাড়িতে বর পক্ষ পৌঁছার পর কনে পক্ষের পুরুষ আত্মীয় স্বজন বিশেষ করে যুবকগন কুয়েতের রীতি অনুয়ায়ী গান গেয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়।
একই সময় অন্দরমহলে কনেকে ঘিরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় “জালওয়া”। কনেসাধারনত সবুজ রঙের পোশাকে সজ্জিত হয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী চেয়ার বা ষ্টেজে আসন নেয়, একই রঙের একটি স্কার্ফ মাথার উপর উঠা নামা করে এবং নারী স্বজনেরা বিয়ের গান করে উদযাপন করে থাকে। পরবর্তীতে পৃথক কক্ষে অপেক্ষমান বরের কাছে কনেকে নিয়ে যাওয়া হয়।
বিয়ের প্রথম সপ্তায় নতুন দম্পতি কনের বাড়ীতে অবস্থান করে। এরপর এ দম্পতি একসাথে বরের বাড়িতে গমন করে, তাদের সহযাত্রী হন কনে পক্ষের নিকটাত্মীয়গন। তবে কনের মায়ের এ যাত্রায় যাওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সামাজিক রীতিতে।
বিয়ে পরবর্তী সুবিধাজনক সময়ে বিবহোত্তর সম্বর্ধনা আয়োজন করা হয়ে থাকে। সাধারনত আবাসিক এলাকার কমিউনিটি হলে পুরুষদের জন্য এবং বরের বাড়িতে মহিলা স্বজনদের জন্য এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় বর একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। আগত অতিথিগণ ক্রমানুসারে বরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করে থাকে; এ সময় বিভিন্ন ধরনের উপহার সামগ্রী প্রদানের রীতিও লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সম্ভর্ধনাস্থলে পুরুষ বিশেষ করে তরুন স্বজন ও বন্ধুরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আরব রীতিতে নেচে নেচে গান করতে দেখা যায়। মহিলা সম্ভর্ধনাস্থলেও মহিলাগনও একই ভাবে গান করে থাকেন।
তবে সময়ের পরিক্রমায় সামাজিক রীতি নীতিতে অনেক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। এখন তরুন তরুনীগন শিক্ষাংগনে, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান যথা শপিং মল, বিনোদন কেন্দ্র বা রেস্টুরেন্টে নিজেদের পছন্দসই পাত্রপাত্রী বাছাইয়ের প্রক্রিয়াও চোখে পড়ে।
নিকটাত্মীয় বা বংশের বাইরেও পাত্র পাত্রী বাছাইয়ে কিছুটা শিথিলতা পরিলক্ষিত হয়। এমনকি বিদেশে পড়াশুনা বা কর্মে নিয়োজিত থাকাকালীন অন্য দেশের নাগরিককেও বিয়ে করতে দেখা যায়। তবে এসব ক্ষেত্রে পাত্র পাত্রী বা সন্তানগন নাগরিকত্বের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। বর্তমান আইন অনুযায়ী বিদেশী পাত্র বা পাত্রী বিয়ের পর কেউ নাগরিকত্ব পায় না; বর কুয়েতি ও কনে ভিনদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতি নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে, তবে কনে কুয়েতি এবং বর বিদেশী হলে সন্তানগন কুয়েতের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে না।
লে.কর্ণেল নাজমুল হুদা খান
টিম প্রধান ও বিশেষজ্ঞ
আন্ডার ওয়াটার মেডিসিন ইউনিট
কুয়েত নেভাল ফোর্স
(প্রেষনে নিযুক্ত)
