
পেছনে মার্কিন যুদ্ধবিমান থেকে ফেলা হচ্ছে নাপাম বোমা। আর সামনে, বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত খালি গায়ে, প্রাণভয়ে ছুটছে ৯ বছরের একটি মেয়ে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়, চিত্র সাংবাদিক নিক উটের তোলা এই ছবি, কাঁপিয়ে দিয়েছিলো বিশ্বকে। সেই ছোট্ট মেয়েটি এখন, ইউনেসকোর শুভেচ্ছাদূত। কাজ করে চলেছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের শিশুদের সহায়তায়।
১৯৭২ সালের ৮ জুন আর্তনাদ করতে করতে রাস্তা দিয়ে ছুটছে শিশুরা। সঙ্গে কিছু সৈনিক। দলটাকে তাড়া করে আসছে কুয়াশার মতো বোমার ঘন কালো মেঘ। তবে এই ছবির মধ্যমণি বছর নয়বছরের কিম ফুক ফান । চোখে মুখে আতঙ্ক, যন্ত্রণা এবং বিভ্রান্তির ছাপ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর বিমানহানায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল নাপাম বোমা। আগুনে ঝলসে গিয়েছিল শরীরের ৩৫ শতাংশ অংশ আর পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল জামাকাপড়।
ছবিটি তুলেছিলেন বার্তা সংস্থা এপির তৎকালীন আলোকচিত্রী নিক উত। বর্তমানে তিনি ফ্রিল্যান্সার আলোকচিত্রী, থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ বন্ধে ভূমিকা রাখা সেই ছবির ৫০ বছর এমন একসময় পূর্ণ হলো যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে। তাইওয়ান ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে চলছে চীনের সামরিক মহড়া। আফগানিস্তান, ইরাক, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলছে সশস্ত্র সংঘাত
দক্ষিণ ভিয়েতনামের ছোট গ্রাম—ত্রাং ব্যাংয়ে। দশটা মেয়ের মতো খুব হাসিখুশি আর স্বচ্ছর ছিলো কিমের পরিবার। বদলে গেল ভয়ংকর এক সকালে হঠাৎ একটি বিমান ধাঁ করে নিচে নেমে এল, কানে তালা ধরিয়ে দেওয়ার মতো শব্দে এরপর বিস্ফোরণ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর দুঃসহ যন্ত্রণা।দৌড়াতে দৌড়াতে ‘নং কুয়া! নং কুয়া!’ (কী ভয়ংকর জ্বলুনি! কী ভয়ংকর জ্বলুনি!) বলছিলাম শিশুটি।
আজ সেই আতঙ্কের পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের আশ্রয়দাতা হয়ে উঠেছেন নাপাম গার্ল । আলোকচিত্রী নিক কিমের জীবন বাঁচিয়েছেন।পরবর্তীতে এই ছবির জন্যই পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন নিক । ছবি তোলার পর তিনি তাঁর ক্যামেরা নামিয়ে রাখেন। একটি কম্বল দিয়ে জড়িয়ে কিমকে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
শরীরে কোনো কাপড় ছিল না তখণ কেন ছবি তোলা হলো এপ্রশ্ন মনে ঘুরেছে বহু বছর নাপাম গার্লের? তবে ‘দ্য টেরর অফ ওয়ার’ ছবিটিকে ঘিরে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছিল আরেকটু বড়ো হতেই। বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর এই নগ্ন ছবিই আন্দোলিত করে তুলেছিল গোটা পৃথিবীকে। যার পরোক্ষ ফলাফল, ১৯৭৫-এ ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান।
নিজের অসহায়তাকেই তিনি বদলে ফেলেছিলেন হাতিয়ারে। এই ছবিকে অস্ত্র করে সামিল হয়েছিলেন শান্তির বার্তা প্রচারের পথে। পেয়েছেন একাধিক শান্তির পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে হয়ে উঠেছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের গুডউইল অ্যাম্বাস্যাডার। সেইসময় থেকেই তাঁর লড়াই চলে আসছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের নিয়ে। বলতে গেলে তাঁদের ত্রাতা হয়ে উঠেছেন ‘নাপাম গার্ল’ আফগানিস্তান যুদ্ধ, সিরিয়া, ইরান— প্রতিটি যুদ্ধের সময়ই তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন নিপীড়িত শিশুদের। কখনও পাঠিয়েছেন ত্রাণ সাহায্য। কখনও আবার তাঁদের অন্যত্র অভিবাসনের বন্দোবস্ত করেছেন স্বয়ং।
সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হল, যে দেশের হামলায় তাঁর এই অবস্থা হয়েছিল, সেই আমেরিকাতেই হল তাঁর ত্বকের চিকিৎসা। সুস্থ হয়ে কিম ফুক বলছেন, ৫০ বছর পর এখন আমি মুক্ত। তাকে আর যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন বয়ে বে়ড়াতে হবে না। নাপাম গার্ল নামে কেউ ডাকবে না। আমি এক জন বন্ধু, এক জন দিদিমা,যে যুদ্ধের ক্ষত মুছে বিশ্বশান্তির আহ্বান জানান। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়েও, অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন ‘নাপাম গার্ল’। চেষ্টা করছেন পৃথিবীর মানচিত্রজুড়ে শান্তির পতাকা ওড়াতে…
শাহনাজ শারমীন/ফই
