
বাংলাদেশ ভিত্তিক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাঙ্ক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার (পি.কে.হালদার) সহ অভিযুক্ত ৫ জনকে ১০ দিনের ইডি রিমান্ডের নির্দেশ দিল স্পেশাল (সিবিআই) কোর্ট। অন্যদিকে অভিযুক্ত এক নারীকে ১০ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিল আদালতের বিচারক মাসুক হোসেন খান (WBJS)। মঙ্গলবার দুপুর একটার আগেই কলকাতার ব্যাংকশাল আদালতের স্পেশাল (সিবিআই) কোর্ট- ১ বিচারক মাসুক হোসেন খান-এর এজলাসে তোলা হয় ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফর্সমেন্ট ডিরেক্টর (ইডি)- এর হাতে গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার, স্বপন মিত্র ওরফে স্বপন মিস্ত্রি, উত্তম মৈত্র ওরফে উত্তম মিস্ত্রি, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার ও আমানা সুলতানা ওরফে শারমিন হালদারকে। কঠোর পাহারায় তাদের রাখা হয় এজলাসের বাম কোণে। সকলকেই তখন নির্লিপ্ত দেখাচ্ছিল। তাদের আইনজীবীদেরও বারেবারে পরামর্শ করে নিতে দেখা যায় মক্কেলদের সাথে। এর পর বিচারক আসার পর শুনানি শুরু হলে অভিযুক্তদের ফের নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানায় ইডির আইনজীবী অরিজিত চক্রবর্তী। আদালতে তিনি জানান অভিযুক্তদের আরো জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন আছে। অন্যদিকে এই মামলায় অভিযুক্ত আমানা সুলতানা ওরফে শারমিন হালদারকে ১০ দিনের জেল রিমান্ডের আবেদন জানায় ইডি। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে আধাঘন্টার কিছু পরে দুই টা নাগাদ বিচারক রায় দেন। সেক্ষেত্রে আগামী ২৭ মে তারিখ তাদের সকলকেই ফের আদালতে তোলা হবে। এদিন ইডির তরফে আদালতের কাছে আরো আবেদন ছিল “ইডির রিমান্ডে নেয়া পাঁচ জনকে প্রতিদিন ইডির আঞ্চলিক কার্যালয় সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে থেকে মেডিক্যাল চেক আপের জন্য বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে, পরিবর্তে হাসপাতালের মেডিকেল অফিসারকে যেন সিজিও কমপ্লেক্সে পাঠানো হয়। এর কারণ হিসেবে আইনজীবী জানান হাইপ্রোফাইল এই মামলার খবর সংগ্রহ করতে প্রতিদিনই অফিস চত্বরে গণমাধ্যমকর্মীরা ভিড় করে থাকেন। তাতে যথেষ্ট বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। তাই তদন্তের স্বার্থে যেন এই অনুমতি দেওয়া হয়। অন্যদিকে উত্তম মিত্র, স্বপন মিত্র- দের আইনজীবী সেখ আলি হায়দার ও সোমনাথ ঘোষ আদালতে জানায় স্বপন মিত্র- এর থাইরয়েড, উচ্চ রক্তচাপ সহ কিছু শারীরিক সমস্যা রয়েছে, তার চিকিৎসার দরকার। পরে বিচারকও স্বপনের কাছ থেকে সেই সমস্যার কথা মনযোগ সহকারে শোনেন। এবং মেডিক্যাল চেক আপের বিষয়টিতে আদালত সম্মতি জানায়। সেক্ষেত্রে তদন্তের স্বার্থেই প্রতি ৪৮ ঘন্টায় একজন মেডিকেল অফিসার সিজিও কমপ্লেক্সে এসে তাদের মেডিক্যাল চেক আপ করবে এবং নির্দিষ্ট ঔষদও দেওয়া হবে জানায় বিচারক। শুনানি শেষে অরিজিৎ চক্রবর্তী জানান “পি.কে হালদার সহ সকল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে একটি আইনেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেটি হল “প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট-২০০২”। অর্থপাচার সম্পর্কিত এই আইনের ৩ ও ৪ ধারায় মামলা করা হয়েছে গ্রেফতারকৃত ছয় জনের বিরুদ্ধে।” স্বভাবতই আইনজীবীকে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পথ প্রশস্ত করার জন্যই কি একটি মাত্র মামলা দায়ের করা হলো? জানাবে অরিজিৎ চক্রবর্তী জানান “এই মুহূর্তে এই বিষয়টিতে কোন কিছুই বলা সম্ভব নয়। কারণ এটা সরকারের সঙ্গে সরকারের কথা হবে। একটা কথাই বলা যেতে পারে যে, আইন আইনের পথে চলবে। উভয় দেশের সরকারের সমন্বয়ে এই আইন আসামিদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হবে।” তার অভিমত “দুই দেশের সরকার ও দুই দেশের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সি গুলির মধ্যে সমন্বয় হলে তবে অতীত থেকে যে শিক্ষা আমরা লাভ করেছে, ভবিষ্যতে আমরা সেই সমস্যাগুলো অনেকটাই দূর করতে পারব। কারণ অতীতেও আমরা দেখেছি এই ধরনের অপরাধীরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে এসেছেন আবার বাংলাদেশ ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে গেছেন। সেসব ক্ষেত্রে জনগণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।” ইডি হেফাজতে থাকা কালীন অবস্থায় অভিযুক্তদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ উদ্ধার করা হয়, যে অর্থের পরিমাণ ভারতীয় মুদ্রায় ১৫০ কোটি রুপির বেশি। এমনকি বেশকিছু ইলেকট্রনিক ডিভাইসও উদ্ধার করা হয়, সেগুলি তদন্ত করে খতিয়ে দেখছে ইডির কর্মকর্তারা। আর সেই কারণেই রিমান্ডের আবেদন জানায় ইডি। যদিও এখনও পর্যন্ত অভিযুক্তরা তদন্তে সহায়তা করছে বলেই জানা গেছে। এব্যাপারে ইডির আইনজীবি জানান “তারা তদন্তে সহায়তা করছেন। পি.কে হালদারের থেকে ভারতীয় মুদ্রায় ১৫০ কোটি রুপির বেশি উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অনেকগুলি ইলেকট্রনিক ডিভাইস উদ্ধার হয়েছে, সেগুলি খুলে দেখা হচ্ছে। সেগুলি তদন্ত সাপেক্ষ।” তিনি আরো জানান “এদের কাছ থেকে ভারতীয় আধার কার্ড সহ বিভিন্ন পরিচয় পত্র, একাধিক দেশের পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও তদন্তের স্বার্থে সেটা এখনই বলা সম্ভব নয় বলেই জানান আইনজীবি। এদিকে পি.কে.হালদার চক্রান্তের শিকার এবং তাকে ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তারই ভাই প্রাণেশ হালদার। এমনকি তাকেও ফাঁসানো হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রাণেশ। আদালতে তোলার আগে এদিন সকালে ইডির আঞ্চলিক দপ্তর সল্টলেকের সিজিও কম্প্লেক্স থেকে পি.কে হালদার, প্রানেশ হালদার দের আলাদা আলাদা ভাবে নিয়ে যাওয়া হয় বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে। সেখানে মেডিকেল চেকআপ করে ফের আলাদা আলাদা ভাবে ফের সিজিও কম্প্লেক্স নিয়ে আসা হয়। এসময় গণমাধ্যমের কর্মীরা প্রশ্ন করলে প্রাণেশ জানান “আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে।” তার অভিযোগ ‘বাংলাদেশের লোক আমাকে ফাঁসাচ্ছে।” প্রাণেশের কাছে সেইসব নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন “এখনও আমি বুঝতে পারছিনা। এর পেছনে রাজনৈতিক যোগ আছে কিনা সেটাও জানি না।” তার বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠা নিয়ে প্রাণেশ জানান “এটা আমার বিরুদ্ধে নয়। আমি জানিনা কোথা থেকে এসেছে। এর সত্যতা আমি নিজেও যাচাই করতে পারিনি। এ বিষয়ে অনুমান করে কিছু বলা যাবে না। আগে জানতে হবে এটা সত্য না মিথ্যা।” তিনি জানান “পিকে হালদার সম্পর্কে তার দাদা।” তার কাছে জানতে চাওয়া হয় পিকে হালদার চক্রান্তের শিকার কিনা? প্রাণেশ পরিষ্কার জানিয়ে দেন “হ্যাঁ, চক্রান্তের শিকার।” যদিও এব্যাপারে এদিন সিজিও কম্প্লেক্স থেকে আদালতে যাওয়ার পথে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন পি.কে হালদার। গণেশের বক্তব্য নিয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে পি.কে জানান “কয়েকটা দিন যেতে দিন।” আর তার এই মন্তব্য ঘিরেই তৈরি হয়েছে জল্পনা।
দীপক দেবনাথ
কলকাতা ১৭.০৫.২০২২
