
বাংলাদেশের সবগুলো জেলায় মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ছে ডেংগু মহামারী। দেশব্যাপি চলতি বছর ইতিমধ্যে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অর্ধ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। মৃত্যূর সংখ্যাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে প্রতিদিন। গত পাঁচ বছরে ডেঙ্গু রোগীর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে এ বছরের জুলাই পর্যন্ত যত মানুষ রোগী মারা গেছে, তা এর আগে কোনও বছরের প্রথম ছয় মাসেও হয়নি।
এমন পরিস্থিতি সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল চার বছর আগে ২০১৯ সালে। ঐ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন এবং মৃত্যু হয়েছিল ১৭৯ জনের। বাংলাদেশে ডেঙ্গু মহামারির ইতিহাসে ঐ বছরই রেকর্ডসংখ্যক রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। তবে গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে আক্রান্তের সংখ্যা (৬১ হাজার) কম হলেও, দেশে সর্বোচ্চ সংখ্যক (২৮১ জন) ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছিল।
এবারের পরিস্থিতি ২০১৯ সালের আক্রান্ত এবং ২০২২ সালের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টগন। কারণ, এ বছর জুলাই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ৪৯ হাজার ১৩৮ জন। এ সময়ে মারা গেছেন ২৪৭ জন। এর মধ্যে শুধু জুলাই মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজার ১৬০ জন, এবং মারা গেছেন ২০০ জন।
এর আগে ২০১৯ সালের জুলাই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ২৫৩ জন এবং মৃত্যু হয়েছে ৪০ জনের। সে বছর অগাস্ট মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৫২ হাজার ৬৩৬ জনে দাঁড়ায়। মারা যায় ৯০ জন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪ বিলিয়ন মানুষ ডেংগু সংক্রমনের ঝুঁকিতে রয়েছে, যাদে ৭০ ভাগ এশিয়া দেশসমূহের। মহামারি আকারে সংক্রমনের ঝুঁকিতে রয়েছে ১২৯টিরও বেশী দেশ।
১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তিন দশকে সংক্রমনের হার বেড়েছে ৮৫%। এভাবে চলতে থাকলে এ শতকের শেষ দিকে পৃথিবীর বেশীর ভাগ মানুষ ডেংগু সংক্রমনের ঝুঁকিতে থাকবে। সংক্রমনকালের রকমফেরঃ বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেংগু মহামারী আকারে দেখা দেয়ার পর থেকে ডেংগুর ধরণ ও প্রকৃতির নানাবিধ পরিবর্তন ঘটেছে, বেড়েছে সংক্রমনের ঝুঁকি ও মৃত্যূর হার। কালের পরিক্রমায় ডেংগু সংক্রমনের সময়েরও পরিবর্তন ঘটেছে।
বাংলাদেশে ডেংগু সংক্রমনের জন্য বর্ষাকাল (জুন- সেপ্টেম্বর), বর্ষা পরবর্তি সময়কাল (অক্টোবর-নভেম্বর) এবং বিশেষ করে সেপ্টম্বরে সর্বোচ্চ ডেংগু সংক্রমনের মাস হিসেবে তথ্য উপাত্তে উল্লেখ রয়েছ । তবে, এ যাবৎকালের সবচেয়ে বড় মহামারীর বছর হিসেবে পরিগনিত ২০১৯ সালে শুধু আগষ্ট মাসেই ৫০% সংক্রমনের ঘটনা ঘটে। এ বছর শুধু জুলাই মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ৪১ হাজারের উপর। ধারণা করা হচ্ছে, ২১ শতকের শেষের দিক বাংলাদেশে সারাবছরই ডেংগু সংক্রমনের ঝুঁকি রয়েছে।
ডেংগু ভাইরাসের ধরণের পরিবর্তনঃ ডেংগুর একটি বিশেষ ধরণের ভাইরাসের সংক্রমন ঘটলে, শরীর যে প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়; তাতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে ঐ ভাইরাসের সংক্রমনের পুনরাবৃত্তি ঘটবেনা। কিন্তু ডেংগু ভাইরাসেরও ধরণে পরিবর্তন ঘটছে। বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ২০০০-২০০২ সালের সংক্রমনে ডেংগু ভাইরাসের DENV-3 এর আধিক্য ছিল। তবে ২০১৩-২০১৬ সালের দিকে DENV-1 এবং DENV-2 ছিল সংক্রমনের মূল ধরণ । ২০১৯ সালে পূনরায় DENV-3 র আবির্ভাব ঘটে। অন্য ধরণ DENV-4 এর উপস্থিতি না থাকলেও, যে কোন সময় এর সংক্রমন ঘটবেনা; সে শংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
নতুন নতুন উপসর্গঃ প্রকৃতি এবং উপসর্গেও পরিবর্তন ঘটেছে এ রোগের। ২০০০ সালের প্রথম মহামারীতে শতকরা ১০০ ভাগ রোগীর জ্বর, ৯০ ভাগের মাথা ব্যাথা, ৮৫ ভাগের হাড়জোড়ে ব্যাথা ছিল অন্যতম প্রধান উপসর্গসমূহ। শতকরা ৫০ ভাগ রোগীর রক্তপাত সংক্রান্ত উপসর্গ যথা: পায়খানার সাথে রক্ত পড়া ও মাড়িতে রক্ত পড়া দেখা যেত। শতকরা ১ ভাগেরও কম রোগীর ডেংগু শক সিন্ড্রোম পাওয়া যেত। কিন্তু ২০১৯ সালের মহামারীতে জ্বরের সাথে প্রধান উপসর্গ ছিল পেটে ব্যাথা ও বমি; হাড়জোড়ে ব্যাথা ছিল খুবই নগন্য। রক্তপাত সংশ্লিষ্ট উপসর্গের হার ছিল খুব কম। তবে ডেংগু শক সিন্ড্রোম বেড়ে দাড়িয়েছিল প্রায় ১০%।
সুতরাং, এটি প্রতিয়মান হয় যে, ডেংগু কালের বিবর্তনে ধরণ ও প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটিয়ে বিপদজনক হয়ে উঠছে। সীমিত স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা, অবকাঠামো, জনবল ও প্রস্তুতির মধ্যেও আমাদের দেশে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ডেংগু রোধে সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহন করছে।
রাজধানীতে ডেংগু ডেডিকেটেড হাসপাতাল কাজ করছে, দেশের সকল জেনারেল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসমূহে ডেংগু ওয়ার্ড ও কর্নার খোলা হয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ডেংগু ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষন প্রদান করা হচ্ছে। সম্ভব সকল প্রয়োজনীয় ঔষধ ও পরীক্ষার সামগ্রী পাঠানো হচ্ছে সেবা প্রতিষ্ঠানসমূহে। সংশ্লিষ্ট ব্লাড ব্যাংকসমূহকে সক্রিয় ও প্রয়োজনীয় রক্তের মজুদ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সিটি কর্পোরেশনসমূহ জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টগনের বিরুদ্ধে জরিমানা করছে। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ মশকের বংশবৃদ্ধি ও মশা নিয়ন্ত্রন কাজ করছে।
ডেংগু মহামারি নিয়ন্ত্রন ও নির্মূলে সারাদেশে এর প্রতিরোধ যুদ্ধ জোরদার করতে হবে। ডেংগু নিয়ন্ত্রনে এডিস মশার বংশবৃদ্ধির মুলে আঘাত হানতে হবে। এডিস মশার বংশবৃদ্ধি নাশঃ সাধারণত টায়ার, ব্যারেল, প্লাস্টিকের ড্রাম ও জেরিকেনের মধ্যে জমা পরিস্কার পানিতে বংশবৃদ্ধি করা পছন্দ করে। এছাড়া এদের বংশবৃদ্ধির জন্য আদর্শ আউটডোর স্থান গুলো হচ্ছে – ব্যাল্কোনিতে থাকা গাছের পাত্র, এসির ট্রে, মাটির পাত্র ইত্যাদি;
ইনডোরে ফ্রিজের ট্রে, রান্নাঘরের র্যাক, রান্নাঘরের / বাথরুমের পানি জমে থাকা ড্রেন, কুলার, বাথরুম বা সিস্টার্নে থাকা লিকেজ, অব্যবহৃত খোলা বালতি/পানির পাত্র, ঘর সাজানোর ফুলের টব / বনসাই প্ল্যান্ট টব / ইনডোর প্ল্যান্ট টব ইত্যাদি। ঘরের ভেতরে বা বাইরে থাকা এসব স্থান দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। যে পানিতে এডিস মশা ডিম দিয়েছে, তা ফেলে দিলেই ডিম ধ্বংস হয়ে যাবে। এ ছাড়া সে পানিতে তেল ঢেলে, সাবান দিয়ে কিংবা ভিনেগার মিশিয়ে ডিম ধ্বংস করা।
লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
