
গতকালের লেখায় স্পেন জিতবে বলে ধারণা দিয়েছিলাম। সেই সাথে আশংকার কথাও লিখেছিলাম। তবে সত্যি বলতে কী! স্বপ্নেও ভাবিনি স্পেনের বিরূদ্ধে রাশিয়া জিতে যাবে। কেনই বা ভাবতে যাবো? যে দলটি বিশ্বকাপের মূল পর্বের আগে আট মাস কোন জয়ের দেখা পায়নি, যে দলটি ফিফার তালিকানুযায়ী বিশ্বকাপের মূল পর্বে অংশগ্রহণরত দলগুলোর মধ্যে নীচের দিকে, গত বিশ্বকাপে যে দলটি ছিল জয়বিহীন সেই দল রাশিয়ার জন্য এবার দ্বিতীয় পর্বে উত্তরণই চাওয়ার অধিক পাওয়া, সে কী করে স্পেনকে হারাবে?
আজ খেলার শুরুতে আমার মেয়ে পূর্ণতা ছিল স্পেনের পক্ষে আর ছেলে পার্থিব ছিল রাশিয়ার পক্ষে। বাসার বাকি সবাইও স্পেন, পূর্ণতাও চায় বাবা তার পক্ষে থাকুক। মনে মনে পার্থিবের সাথে পরাজয়ের বেদনা ভাগ করে নেওয়ার জন্য আমিও রাশিয়ার পক্ষে, ছোট্ট ছেলেটা যাতে পরে একা কষ্ট না পায়। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ তো আসলে বিস্ময় কাপ। খেলার অধিকাংশ সময় স্পেন ভাল খেললেও রাশিয়ার রক্ষণভাগের দৃঢ়তায় নির্ধারিত সময়ে খেলার ফলাফল ছিল ১-১, অতিরিক্ত সময়েও কোন পক্ষ গোল দিতে পারেনি। শেষমেষ টাইব্রেকারে খেলা গড়ালে রাশিয়ার গোলরক্ষক আকিনফিভ দুদুটো পেনাল্টি ঠেকিয়ে একাই যেন দলকে জিতিয়ে দেন, নিশ্চিত করেন দলের কোয়ার্টার ফাইনাল। আমি প্রায় দশটা ফুটবল বিশ্বকাপ দেখার অভিজ্ঞতায় কোনদিনও কোন গোলরক্ষককে পা দিয়ে এমনভাবে পেনাল্টি ঠেকাতে দেখিনি। কাল খেলার শেষে বৃষ্টি নেমেছিল, ভেজা মাঠে খেলোয়াররা টুকটাক আছাড়ও খাচ্ছিল। খেলা শেষে সেই বৃষ্টির জলে মিশে গিয়েছিল স্পেনের খেলোয়াড়দের চোখের জল!
এবার খেলায় নেইমার নতুন একটা স্টাইল চালু করেছেন। গোল দিতে ব্যর্থ হলে লজ্জায় জার্সিতে মুখ ঢেকে ফেলছেন খেলোয়াড়রা, যাতে ক্যামেরায় তাদের মুখ না দেখা যায়। টাইব্রেকারে রাশিয়ার বিরূদ্ধে পেনাল্টিতে গোল করতে ব্যর্থ হয়ে কাল জার্সিতে মুখ ঢেকেছিলেন স্পেনের খেলোয়াড় কোক। খেলোয়াড়দের জার্সিতে মুখ ঢাকা দেখে শঙ্খ ঘোষের কবিতাটির কথা মনে পড়ে যায় ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’।
মধ্যরাতের খেলায় ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ডেনমার্ক প্রথম মিনিটেই গোল দিয়ে বসে যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে অন্যততম দ্রুততম গোল। পিছিয়ে ছিল না ক্রোয়েশিয়াও, ফলে প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যেই খেলার ফলাফল ১-১, অতিরিক্ত সময়ের শেষেও যা আর বদলায়নি। খেলা শেষের পাঁচ মিনিট আগে পাওয়া ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি কিক যখন ডেনমার্কের গোলরক্ষক স্মেইকেল বাম দিকে ঝাপিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন, তখন মনে হচ্ছিল উত্তেজনার এখনো ঢের বাকী। পেনাল্টিতেও প্রায় সমানে সমান ছিল দুদল, শেষ পেনাল্টিটা ঠেকিয়ে ক্রোয়িশয়াকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গেলো গোলরক্ষক সুবাসিচ। সুবাসিচ বিশ্বকাপের ইতিহাসের অন্যতম গোলরক্ষক যে টাইব্রেকারে পাঁচটির মধ্যে তিনটি পেনাল্টি শটই রুখে দিয়েছেন। সত্যি বলতে কী, চরম উত্তেজনায় কেটেছে কালকের রাত।
কালকের খেলা দুটো দেখে আমার ক্যাডেট কলেজের বাংলা শিক্ষক, কবি প্রয়াত রফিক নওশাদ স্যারের একটা কথা খুব মনে পড়ছিল। একবার এক সাহিত্য প্রতিযোগিতার শেষে স্যার আমাকে বলেছিলেন, ‘সারা মাঠ ভালো খেললে, কিন্তু গোল করতে পারলে না হাসনাৎ’। কাল নির্ধারিত সময়ে স্পেন এবং ক্রোয়েশিয়া তুলনামূলকভাবে ভাল খেললেও জেতার মত গোল করতে পারেনি। ফুটবল গোলের খেলা। যতই বলের উপর দখল থাকুক আর গোলে শট নেওয়া হোক কিংবা অ্যাকুরেটলি পাস দেওয়া হোক, জিততে হলে প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশী গোল দিতে হবে। ফুটবলের এই পাঠ জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সারা মাঠ ভালো খেলে লাভ নাই, যদি না গোল দেওয়া যায়।
আজ রাত আটটায় মেক্সিকোর বিপক্ষে ব্রাজিলের খেলা। আর্জেন্টিনার পরাজয়ে আর স্পেনের বিদায়ে ঝিম মেরে গেছে ব্রাজিলের সমর্থকরা। ফুটবল ঐতিহ্য আর অতীত পরিসংখ্যানের উপরে আর বেশী নির্ভর করা যাচ্ছে না। এবারের বিশ্বকাপে মেক্সিকোর পারফর্মেন্স সবার নজর কেড়েছে। আজ জিততে হলে নেইমার, কৌতিনহো ও অন্যান্যদের জ্বলে উঠতেই হবে। নইলে পত্রপাঠ বিদায়! মধ্যরাতে বেলজিয়ামের বিপক্ষে খেলতে নামবে এশিয়ার দল জাপান। খেলার ধারানুযায়ী বেলজিয়ামের জয়ের সম্ভাবনা বেশী, তারপরও অঘটনের বিশ্বকাপ নিয়ে আগেভাগে নিশ্চিত করে আর কিছু বলা যায় না।
আর্জেন্টিনার পরাজয়ের রেশ এখনো কাটেনি, আত্মহত্যা করেছেন ধামরাইয়ের এক যুবক। কক্সবাজারে ব্রাজিল সমর্থকদের পিঠিয়ে আহত করেছেন আর্জেন্টিনার সমর্থকরা। জয়-পরাজয় খেলারই অংশ, প্রিয় দলের পরাজয়ে মন খারাপ হওয়াও স্বাভাবিক। তাই বলে আত্মহত্যার মত বিধ্বংসী পথ বেছে নেওয়া যাবে না। মাঠের খেলার ফলাফল যাই হোক না কেন, জীবনের খেলা চলতে থাকুক। জয়তু জীবন!
