বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের করাচি থেকে কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ সরাসরি এসে ভিড়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে। ওই কন্টেইনারগুলোতে কী আনা হয়েছে? গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
এত বছর পর বাংলাদেশে কেনই বা বিষয়টি এত তাৎপর্যপূর্ণ? এ বিষয়ে কিন্তু মানুষের কৌতুহল অনেক অনেক বেশি। পাকিস্তানের করাচি থেকে আসা জাহাজটির কন্টেইনারে কী কী আছে তা নিয়ে জানতে জনসাধারণের পাশাপাশি প্রচন্ড আগ্রহ তৈরী হয়েছে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মহলে।
গত ১৩ই নভেম্বর পাকিস্তানের করাচি থেকে ছেড়ে আসা ‘এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং’ নামের ওই জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েছিলো। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, পণ্য খালাস হয়ে গেলে পরদিনই জাহাজটি বন্দর ত্যাগ করে। একটি সূত্র জানিয়েছে, ‘দুবাই টু চট্টগ্রাম’ রুট ধরে আসা জাহাজটির পরবর্তী গন্তব্য ইন্দোনেশিয়া। নতুন এই সার্ভিসটি চালু করেছে দুবাই ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান।
জাহজটিতে যা যা আনা হয়েছে
পাকিস্তান থেকে কন্টেইনারবাহী জাহাজটির সরাসরি বাংলাদেশে আসার খবর প্রকাশ পাওয়ার পর বাংলাদেশের মতো পাকিস্তানেও বেশ আগ্রহ তৈরি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক গণমাধ্যমকে বলেন, ”আমাদের কাছে ৩৭০টি কন্টেইনার এসেছে। সেগুলোর মাঝে কী আছে, তা কাস্টমস বলতে পারবে। ওটা আমাদের এখতিয়ার না।”
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ সাইদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ”৩৩৭ টন ওজনের ফ্রেবিকস, চুনাপাথর, সোডা অ্যাশ, পেঁয়াজ, ম্যাগনেশিয়াম কার্বোনেট, ডলোমাইট এসব আছে।” এর মধ্যে ১১৫ কন্টেইনারে রয়েছে সোডা অ্যাশ। ডলোমাইট রয়েছে ৪৬টি কন্টেইনারে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কন্টেইনারগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই টেক্সটাইল শিল্পের কাঁচামাল। এর মধ্যে আরো আছে কাঁচ শিল্পের কাঁচামাল, গাড়ির যন্ত্রাংশ, রং, কাঁচামাল কাপড় প্রভৃতি। ৪২টি কন্টেইনারে রয়েছে পেঁয়াজ। ১৪টি কন্টেইনারে রয়েছে আলু।
এসব পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশের আজিক গ্লাস কারখানা, প্যাসিফিক জিনস, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, নাসির গ্লাস, এক্স সিরামিকস, হাফিজ করপোরেশন, এম আর ট্রেডিংস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান।
মোহাম্মদ সাইদুর রহমান জানান, সবগুলো কন্টেইনার করাচি থেকে জাহাজে লোড হয়নি। কিছু কন্টেইনার দুবাই থেকে জাহাজটিতে লোড করে বাংলাদেশে আনা হয়েছে। পাকিস্তান থেকে জাহাজে লোড হয়েছে ২৯৭টি কন্টেইনার, বাকিগুলো লোড হয়েছে দুবাই থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে খেজুর, মার্বেল ক্লক, কপার ওয়্যার, জিপসাম, লোহার টুকরো। একটি কন্টেইনারে অ্যালকোহল জাতীয় পণ্যও রয়েছে।
সাধারণত বড় কন্টেইনার বহনকারী জাহাজগুলোতে বিভিন্ন বন্দর থেকে মালামাল নামানো বা তোলা হয়ে থাকে। ফলে একটি জাহাজে বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে যেমন কন্টেইনার তোলা হয়, তেমনি বিভিন্ন দেশের বন্দর থেকে আপলোড করা কন্টেইনার তারা নির্দিষ্ট কোন বন্দরে নামিয়ে দিতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা কি বলছেন
এই খাতের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাধারণত একটি বড় কন্টেইনারবাহী জাহাজে অন্তত সাতশো থেকে একহাজার কন্টেইনার বহন করে থাকে। ফলে কোন দেশের সাথে আরেকটি দেশের বড় আকারের বাণিজ্য না হলে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল করে না।
এক্ষেত্রে তৃতীয় কোন বন্দরে জাহাজ বদল করে অথবা অন্য আরো দেশের পণ্যের সাথে জাহাজে কন্টেইনার পরিবহন করা হয়।
যেমন এখন চীন থেকে সরাসরি কন্টেইনার নিয়ে বাংলাদেশে জাহাজ আসে। জাপান থেকেও কখনো কখনো এখন জাহাজ আসে। কয়েক বছর আগে ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকেও মালামাল নিয়ে জাহাজ ভিড়তো।
এর বাইরে ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা নিয়ে বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল বা গ্যাস নিয়ে জাহাজ সরাসরি আসে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলছেন, পাকিস্তান থেকে খোলাভাবে পণ্য আগেও আসতো, এখনও আসে। সেগুলো তৃতীয় দেশের বন্দরে নামানোর পর জাহাজ বদল করে বাংলাদেশে আসে।
কিন্তু পাকিস্তান থেকে সরাসরি “কন্টেইনারে করে এই প্রথম এসেছে। এগুলো মালপত্র বোঝাই কার্গো।”
তিনিও বলেন যে কন্টেইনারে কী আছে, তা কেবল এজেন্ট এবং কাস্টমস জানবে।
তবে তিনি জানান, “কন্টেইনারে সাধারণত ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি থেকে শুরু করে ইকুইপমেন্ট, সব আসে। এখানে কোনও ধরাবাধা নিয়ম নাই। শুধু কন্টেইনারের সাইজে রেস্ট্রিকশনস আছে।”
বাংলাদেশ-পাকিস্তান বাণিজ্যিক সম্পর্ক
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, “দুবাই থেকে চট্টগ্রাম, এই সার্ভিস আমাদের আগে থেকেই আছে। এইবার আসার সময় তারা করাচি বন্দর হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। স্বাধীনতার পরে সরাসরি এভাবে কোনও জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে কি না, তা আমার জানা নেই। আমার জানা মতে, এইবার সরাসরি এসেছে।”
“পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য আগে থেকেই ছিলো। আগে পাকিস্তান থেকে যে কন্টেইনার আসতো, তার কিছু আসতো সিঙ্গাপুর হয়ে, কিছু আসতো কলম্বো হয়ে,” যোগ করেন তিনি।
করাচি থেকে বাংলাদেশের চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৬১২ নটিক্যাল মাইল। কিন্তু একটি জাহাজে যত কন্টেইনার বহন করা হয়, তত কন্টেইনার করাচি থেকে বাংলাদেশে আসে না। ফলে নতুন সেবা চালু করা প্রতিষ্ঠান দুবাই ভিত্তিক কন্টেইনার বহনকারী কোম্পানি আরো কয়েকটি দেশের বন্দরকে এর সাথে যুক্ত করেছে।
এসব জাহাজ দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি হয়ে, ভারতের মুন্দ্র হয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে আসবে। আবার এখান থেকে মালয়েশিয়ার কেলাং এবং ইন্দোনেশিয়ার বেলাওয়ানে চলে যাবে।
এর ফলে আগে তৃতীয় দেশ হয়ে পণ্য আনা-নেয়ায় যে বাড়তি খরচ হতো ও অতিরিক্ত সময় লাগতো, সেটা আর লাগবে না।
১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বহু বছর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্য হতো না। আর এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। পরবর্তীতে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপিত হয়। তবে, পাকিস্তান থেকে সাধারণত সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রামে আসতো না। সে দেশের পণ্যবাহী জাহাজ প্রথমে শ্রীলঙ্কায় কন্টেইনার খালাস করতো। এরপর জাহাজ বদল করে সেসব কন্টেইনার বাংলাদেশে আসতো।
বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে ঢাকা ও করাচির মাঝে শীতল সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সীমিত হতে থাকে। তখন নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে আমদানি করা অধিকাংশ পণ্য “লাল তালিকাভুক্ত” করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তানের অনুরোধে গত ২৯ সেপ্টেম্বর লাল তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছে দেশটির সব ধরনের পণ্য।
গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে অধ্যাপক ইউনূস ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফের মধ্যে বৈঠকের ঘোষণায়ও উল্লেখ করা হয় যে দুই দেশই বিভিন্ন স্তরে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক উন্নয়নে আরও অনেক তৎপরতা লক্ষ্য করছেন কূটনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা।
এতকিছুর মাঝে নতুন করে এই জাহাজ ভেড়ার খবর দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে উষ্ণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাংলাদেশে পাকিস্তান হাই কমিশন গত বুধবার তাদের ভেরিফায়েড এক্স (পূর্বের টুইটার) হ্যান্ডেলে এটিকে “দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ” হিসাবে সঙ্গায়িত করেছে।
ওই টুইটে আরও বলা হয়, এই “নতুন রুট সরবরাহ ব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মাঝে আনবে, ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ খুলে দিবে।”
যদিও সামাজিক মাধ্যমে ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে’ আসা বলে ব্যাপক আলোচনা হলেও, আসলে জাহাজটি দুবাই থেকে ইন্দোনেশিয়া যাবার পথে করাচি ও চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার লোড বা আনলোড করেছে। যাইহোক তাতেই বা কী আসে যায়? দেশের বুদ্ধিজীবীদের কথায় কথায় ‘রাজাকার’ ও ‘পাকিস্তানী’ বলে অন্যদের তিরস্কারের স্টান্টবাজি বন্ধ রয়েছে ৫ আগস্ট থেকে।