বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের মংডু শহর দখলের দাবি করেছে দেশটির বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ২৭০ কিলোমিটার এলাকা পুরোপুরি বিদ্রোহী গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রণে গেল।
সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদনে জানা যায়, গত কয়েক মাস ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ের পর মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এএ। গত রোববার মংডু শহর দখল করে বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা মিয়ানমারের ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহীরা। আরাকান আর্মি গত মে মাসের শেষ দিকে মংডু আক্রমণ শুরু করে। আর সীমান্তবর্তী এই শহরের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেতে ছয় মাস সময় লাগল।
আরাকান আর্মি জানিয়েছে, মিয়ানমার জান্তার শেষ অবশিষ্ট সীমান্ত ঘাঁটি মংডু শহরের বাইরে অবস্থিত বর্ডার গার্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন নং ৫ বেশ কয়েক মাস লড়াইয়ের পর রোববার সকালে দখল করা হয়েছে। ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় আরাকান রোহিঙ্গা আর্মি (এআরএ), আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) সরকার এবং সহযোগী রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়।
ইরাবতীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আরাকান আর্মি এখন বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের তিনটি শহরেরই নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দাবি করছে। এগুলো হলো, রাখাইন প্রদেশের মংডু ও বুথিডাং এবং চিন প্রদেশের পালেতোয়া। আরাকান আর্মি এখন দক্ষিণ রাখাইনের গয়া, তাউনগুপ ও আন শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য লড়াই করছে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানের তিন বছরের মাথায় জান্তা সরকার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। বিদ্রোহীদের আক্রমণে সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী বিজিপিসহ সরকারি সব বাহিনী কোণঠাসা। এমন অবস্থায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দ্রুত হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী।
স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে দেশটির মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের ওপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে চলে গেছে ৫২ শতাংশ ভূখণ্ড।
সামরিক বাহিনী প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং তারা দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অবস্থায় জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দ্রুত হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী।
মিয়ানমারের সেনা শাসনের ইতিহাস:
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারের রয়েছে দীর্ঘ সময়ের সেনা শাসনের ইতিহাস। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর প্রায় ৫৫ বছর দেশটি থেকেছে সেনা শাসনের অধীনে।
গত অক্টোবরে জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে সামরিক টহল চৌকি, অস্ত্রাগার ও বেশ কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদ্রোহীদের হাতে। সবশেষ ঘুমধুম সীমান্তে বিদ্রোহীদের আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীরা দলে দলে আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী চীন ও ভারতেও মিয়ানমারের সেনারা আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। এ ধরনের বিজয় বিদ্রোহী অন্য গোষ্ঠীগুলোকেও সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণে উৎসাহিত করেছে।
যে বিদ্রোহীদের আক্রমণে কোণঠাসা সেনাবাহিনী, আসলে তাদের শক্তি কতটা? ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদন বলছে, মিয়ানমারের বিরোধী সশস্ত্র দলে জাতিগত ২০টি গোষ্ঠীর এক লাখ ৩৫ হাজার সদস্য, ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট-এনইউজির আওতায় পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের ৬৫ হাজার সদস্য এবং সিভিল ডিসঅবিডিয়েন্ট মুভমেন্টের অধীনে প্রায় দুই লাখ সদস্য রয়েছে।
আর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দাবি করছে, তাদের রয়েছে চার লাখ সেনা। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর পিস-এর তথ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে প্রায় দেড় লাখের মতো সেনা রয়েছে। এর মধ্যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত বা ‘কমব্যাট রেডি’ ৭০ হাজার সেনাও অন্তর্ভুক্ত।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর দেশটির পার্লামেন্টারি নির্বাচনে অং সান সুচির ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৪১২ আসনের মধ্যে ৩৪৬টিতে জয় পায়। কিন্তু অধিবেশন শুরুর প্রাক্কালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে সেনাবাহিনী।
এরপর ২০২১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী ক্ষমতা দখল করে। এরপর থেকে তাদের নিপীড়ন-নির্যাতন ও হামলায় অন্তত সাড়ে চার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। বন্দী করা হয়েছে ২৫ হাজার মানুষকে। জান্তা বাহিনীর নৃশংস হামলায় মিয়ানমার জুড়ে অন্তত ৭৮ হাজার বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সূচকে, বিশ্বের সবচেয়ে নিকৃষ্ট সরকার হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।
২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটির এক কোটি ৮৬ লাখ মানুষ একপ্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছে, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ।
জাতিসংঘের মানবিক ত্রাণ সহায়তা বিষয়ক সংস্থার হিসাব বলছে, সেখানে এই পৌনে দুই কোটি মানুষের জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীর প্রতিবেদন উঠে এসেছে এমন তথ্য।
জাতিসংঘ মিয়ানমারকে বিশ্বের অন্যতম ‘হাঙ্গার হটস্পট’ বলে ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, যেকোনো সময় দেশটিতে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির হিসাব বলছে, মিয়ানমারের খাদ্য সংকট দেশটির প্রায় এক কোটি ২৯ লাখ মানুষকে ভোগাবে। অর্থাৎ, দেশটির প্রতি চারজনে একজন মানুষ খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় আছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, গৃহযুদ্ধের কারণে মাত্র তিন বছরে দেশটিতে অন্তত ২১ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে তাঁদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। এরমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
গ্লোবাল পিস ইনডেক্স-২০২৩-এর হিসাব অনুসারে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর শীর্ষে আছে মিয়ানমার। এই অঞ্চলের ১৯টি দেশের মধ্যে মিয়ানমারের অবস্থান ১৮। এর আগে আছে কেবল উত্তর কোরিয়া। অর্থাৎ সেই হিসাবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিতীয় শীর্ষ বিপজ্জনক দেশ মিয়ানমার।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কারাবন্দী করার দিক থেকেও শীর্ষে আছে মিয়ানমার। ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার প্রায় ২০ জন রাজনৈতিক বিরুদ্ধ মতের নেতা-কর্মীকে কারাদণ্ড দিয়েছে, এরমধ্যে প্রায় চার হাজারই নারী।
সাংবাদিকদের কারাদণ্ড দেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমার বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষদেশ। ২০২৩ সালেই জান্তারা ৪৩ জন সাংবাদিককে কারাদণ্ড দিয়েছে। আটক ১৯২ সাংবাদিকদের মধ্যে এখনো কারাবন্দী অন্তত ৬১ জন। এছাড়া, নাগরিক স্বাধীনতা সূচকে মিয়ানমার ৬০ পয়েন্টের মধ্যে মাত্র ৯ পয়েন্ট পেয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অধিকার সূচকে অবস্থান শূন্য। পরিবেশ সূচকেও তলানিতে দেশটি। এমনকি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকাতেও রয়েছে মিয়ানমার।