ঊনিশ শতকের শেষের কথা। ঢাকা পূর্ববঙ্গের প্রধান শহর হলেও কলকাতার সাথে দৃশ্যমান ফারাক অনেক। সেই ১৮৫৭ সাল থেকেই কলকাতার রাস্তায় দেখা যায় গ্যাস বাতির ব্যবহার। আর এদিকে রাত নামলে পূর্ববঙ্গের বিস্তৃত জনপদে নেমে আসে অন্ধকার। ঢাকা আর পাঁড়া গা’গুলোকে তখন আর আলাদা করে চেনার উপায় থাকে না। শহরের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় কেরোসিন বাতির ব্যবস্থা থাকলেও সামান্য জোর হাওয়া কিংবা বৃষ্টিতে সে বাতির আয়ু ফুরিয়ে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। বিত্তবানদের ঘরে তবু ঝাড়বাতির চল আছে। বাদবাকি সবই চলে হারিকেন, কুপি বাতি আর মোমের আলোয়।
১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ সরকার নবাব আবদুল গণিকে নাইট কমান্ডার অভ দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া (কে.সি.এস.আই) উপাধিতে সম্মানিত করে। পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ পিতার এই প্রাপ্তিকে স্মরণীয় রাখার জন্য ঢাকার রাস্তায় গ্যাস বাতির ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতি দেন। নবাবের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সড়কে তেলের বাতি বদলের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে বিলম্বিত হতে থাকে গ্যাস বাতি স্থাপনের কাজ। দেখতে দেখতে কেটে যায় এক যুগেরও বেশি সময়। মানব সভ্যতার ইতিহাসে আগমন ঘটে এক নতুন শতাব্দীর। ঢাকার রাস্তায় তবু গ্যাস বাতির দেখা মেলে না।
নবাব আহসানউল্লাহ কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার কথা রাখতে পেরেছিলেন। এবার আর শুধু গ্যাস বাতি নয়, সরাসরি বিজলি বাতির ব্যবস্থা করে তিনি ঢাকাবাসীকে চমকে দিলেন । মৃত্যুর মাত্র ন’দিন পূর্বে নবাব বাহাদুরের স্বপ্ন পূর্ণ হলো, রাখলেন নগরবাসীকে দেওয়া দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি। সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হলো। ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে জ্বলে উঠলো বিজলি বাতি। আলো জ্বলল নবাবের প্রিয় আহসান মঞ্জিলেও।
বাংলায় বিজলির আগমন
টমাস আলভা এডিসন ১৮৭৯ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানলো পার্কে প্রথম বিজলি বাতিটি জ্বেলেছিলেন। এরপর বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবহার দেখা যায় লন্ডনে, ১৮৮০ সালে। কয়েক বছরের মধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকার ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় বিদ্যুৎ। অবশ্য গ্যাস বাতি আর মোমের ব্যবহার ছেড়ে বৈদ্যুতিক আলোয় অভ্যস্ত হতে পশ্চিমাদেরও দীর্ঘ সময় লেগেছিল। তার ওপর বিদ্যুতের খরচও ছিল তুলনামূলক বেশি। এদিকে লন্ডনে বাতি জ্বলার পর ইংরেজদের উদ্যোগে ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতাতেও বিদ্যুৎ নিয়ে আসা হয় ।
১৮৯৫ সালে পাশ হয় ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট। ১৮৯৭ সালে লন্ডনের কিলবার্ন কোম্পানির হাত ধরে যাত্রা শুরু করে ইন্ডিয়ান ইলেকট্রনিক কোম্পানি লিমিটেড, পরে যার নাম বদলে রাখা হয় ক্যালকাটা ইলেকট্রনিক সাপ্লাই লিমিটেড। এর আগে জেনারেটর ব্যবহার করে বাতি জ্বালানো হলেও কলকাতায় প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয় ১৮৯৯ সালে। ক্যালকাটা ইলেকট্রনিক সাপ্লাই লিমিটেডের উদ্যোগে পাতা হয় স্থায়ী বৈদ্যুতিক লাইন। হ্যারিসন রোড অর্থাৎ বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোডে জ্বলে ওঠে কলকাতার প্রথম বিজলি বাতি।
ঢাকায় বিংশ শতাব্দীতে বৈদ্যুতিক সড়ক বাতি চালু হলেও পূর্ববঙ্গে প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী ছিলেন গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা। শোনা যায়, ঊনিশ শতকেই তিনি বিলাত থেকে জেনারেটর আমদানি করে রাজবাড়ি আলোকিত করেছিলেন।
ঢাকার রাস্তায় সড়ক বাতি
ঢাকায় বাতি ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬৯ সালে। মিউনিসিপ্যালিটির সভাপতি ও ম্যাজিস্ট্রেট জর্জ গ্রাহামের নির্দেশ অনুযায়ী, সিভিল সার্জন ড. হেনরি কাটক্লিফ ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ও উন্নয়ন বিষয়ক একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেন। রিপোর্টে তিনি ঢাকার রাস্তায় সড়ক বাতি স্থাপনের কথা তুলে ধরেন। তবে গ্যাস বাতির বদলে কাটক্লিফ কেরোসিন বাতি জ্বালানোর প্রস্তাব রাখেন। রিপোর্ট দেখে নবাব খাজা আবদুল গণি বলছিলেন, এ রিপোর্ট বাস্তবায়িত হলে ঢাকা স্বর্গে পরিণত হবে। কিন্তু ঢাকার মানুষের আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল নয়। আর তাই নগর উন্নয়নে আর্থিক অনুদান দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
১৮৭০ সালে নবাব আব্দুল গণি নিজেই ঢাকায় একটি গ্যাস লাইট ফ্যাক্টরি স্থাপন করেন। এদিকে ১৮৭৭ সালে রানী ভিক্টোরিয়া ভারতসম্রাজ্ঞী ঘোষিত হলে ব্রিটিশ সরকার ঘটনাটি উদযাপনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করে। ঢাকায় আয়োজন উপলক্ষে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয় নাগরিক কমিটি। মিটির উদ্যোগে সদস্যদের চাঁদায় ৬,৫০০ টাকার ফান্ড গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, ওয়াইজঘাটে তৎকালীন মিউনিসিপালিটি অফিস থেকে শুরু করে চকবাজার পর্যন্ত কেরোসিনের ১০০টি সড়কবাতি স্থাপন করা হবে। পরে এ প্রকল্পের আওতায় ৬০টি কেরোসিন ল্যাম্পপোস্ট বসানো হয়।
সড়কে কেরোসিনের বাতিই ছিল মূল ভরসা। কিন্তু, সামান্য ঝড়-বৃষ্টিতেই বাতি নিভে গিয়ে নেমে আসত অন্ধকার। মজার ব্যাপার হলো, রোজ এই কেরোসিন বাতি জ্বালানো-নেভানোর জন্য ঊনিশ শতকে বাতিওয়ালা নামে এক নতুন পেশাজীবী সম্প্রদায়ের বিকাশ ঘটে। সন্ধ্যা নামলেই বড় বড় মই হাতে এই বাতিওয়ালাদের দেখা মিলত। বিদ্যুৎ আসলেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত কেরোসিন বাতির প্রচলন ছিল। ১৯৩৫ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকার রাস্তায় ৮৬৯টি কেরোসিন বাতি ও ১,০৬৬টি বৈদ্যুতিক সড়কবাতি ছিল।
নবাব বাহাদুরের প্রতিশ্রুতি
১৮৮৬ সালে নবাব আবদুল গণি কে.সি.এস.আই. উপাধি লাভ করলে পুত্র নবাব আহসানউল্লাহ ঢাকার রাস্তায় গ্যাস বাতি বসানোর ঘোষণা করেন। কলকাতার ইংলিশম্যান পত্রিকার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন-
“আমার পিতার ‘নাইট কমান্ডার অভ দ্য স্টার অভ ইন্ডিয়া’ উপাধি প্রাপ্তিতে নগরবাসী যে উল্লাস-উদ্দীপনা দেখিয়েছে, তাতে আমি অভিভূত। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের প্রদর্শিত এই সৌজন্যের প্রতিদান হিসেবে আমি ঢাকার প্রধান রাস্তাগুলোতে সম্পূর্ণ নিজ খরচে তেলের বাতি বদলে গ্যাস বাতি স্থাপনের প্রস্তাব রাখছি। তবে এখানে আমার একটা শর্ত থাকবে। আলোক প্রজ্জ্বলনে যে অর্থ ব্যয় হবে, মিউনিসিপ্যালিটিকে তার বদলে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দমকল যন্ত্র ক্রয় ও রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।”
১৮৮৮ সালে ভারতবর্ষের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড ডাফারিন ঢাকায় আসেন। ডাফারিনের ঢাকায় আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নবাবের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সড়কে গ্যাস বাতি বসানোর নিদের্শনা প্রদান। ভাইসরয় চলে যাবার পর কার্যক্রম একরকম স্থবির হয়ে পড়ে। নবাব আহসানউল্লাহর লিগ্যাল সেক্রেটারি জি. এল. গার্থ গ্যাস বাতি স্থাপনের জন্য ১৮৯১ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির কাছে পুনরায় একটি মেমো লিখে পাঠান। পৌরসভা মেমোটি বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করে। তবে কোনো কারণে শেষ পর্যন্ত বাতি স্থাপন সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
এরপর কেটে যায় এক দীর্ঘ সময়। ততদিনে নবাবের প্রতিশ্রুতির কথা মানুষ সম্ভবত ভুলতে বসেছে। ১৮৯৭ সালে নবাব খাজা ইউসুফজান পৌরসভার সভাপতি হন। সম্পর্কে তিনি নবাব আহসানউল্লাহর বোনের স্বামী ছিলেন। পরের বছর ঢাকা প্রকাশ পত্রিকায় ফের সড়ক বাতির প্রসঙ্গ ওঠে। নবাব আহসানউল্লাহকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয় যে, এতদিন হয়তো তিনি পৌরসভার উপর ভরসা রাখতে পারতেন না। আর তাই বারো বছরেও সড়কে গ্যাস বাতির দেখা মেলেনি। এবার স্বয়ং নবাবের দুলাভাই পৌরসভা প্রধান হওয়ার পর সড়ক বাতির আশা করতে আর কোনো দ্বিধা রইল না।
পত্রিকার সমালোচনার জন্য হোক বা না হোক, নবাব আহসানউল্লাহ এবার সত্যিই সড়কবাতি স্থাপনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। তবে ‘কাগুজে নবাব’ হলেও তিনি যেকোনো রাজা বাদশাহর চেয়ে কম নন, সে প্রমাণও রাখলেন। গ্যাস বাতির পরিবর্তে এবার বিলাতি বিদ্যুৎ বাতির পেছনে ঢাললেন লাখ লাখ টাকা।
দি ঢাকা ইলেকট্রিক লাইট ট্রাস্টিস ও মেসার্স অক্টাভিয়াস স্টিল এন্ড কোম্পানি
১৯০১ সালে ‘দি ঢাকা ইলেকট্রিক লাইট ট্রাস্টিস’ গঠন করা হয়। এ কমিটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয় পৌরসভাকে। বাতি স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষনের জন্য কমিটির ফান্ডে নবাব সাড়ে চার লক্ষ টাকা দান করেন। একই বছর ৫ জুলাই, ট্রাস্টি কমিটির পক্ষ থেকে জেমস থমাস রেনকিনের স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রচারিত হয়। সেখানে লেখা হয়, দি ঢাকা ইলেক্ট্রিক লাইট ট্রাস্টিস ১৮৯৫ সালের আইন অনুযায়ী, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইসেন্সের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত সড়কগুলো ছিল- রহমতগঞ্জ রোড, চকবাজার সার্কুলার রোড, মোগলটুলি রোড, নালগোলা রোড, বাবু বাজার রোড, কমিটিগঞ্জ রোড, আরমেনিয়া স্ট্রিট (রায় বাহাদুর সড়ক পর্যন্ত), ইসলামপুর রোড, আহসানমঞ্জিল রোড, পাটুয়াটুলি রোড, ওয়াইজঘাট রোড, পাটুয়াটুলি লোয়ার রোড, বাংলাবাজার রোড, ডাল বাজার রোড. ফরাশগঞ্জ থেকে লোহারপুল রোড, দিগবাজার রোড. ভিক্টোরিয়া পার্ক, লক্ষ্মীবাজার রোড, সদরঘাট রোড. শাঁখারিবাজার রোড. জনসন রোড. নবাবপুর রোড. রেলওয়ে স্টাফকোয়ার্টার রোড (রমনা টিচিং গ্রাউন্ড পর্যন্ত) জামদানি নগর রোড ও রাজার দেউড়ি লেনসহ সাহেব বাজার পর্যন্ত যতগুলো রাস্তার সংযোগ থাকে।
কলকাতার মতো ঢাকাতেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব পায় ইংল্যান্ডভিত্তিক একটি কোম্পানি। ‘মেসার্স অক্টাভিয়াস স্টিল অ্যান্ড কোম্পানি’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ঢাকায় প্রথম বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ শুরু করে। বর্তমান হাতিরপুল এলাকায় ছিল কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। ১৯১৯ সালে প্রতিষ্ঠানটির অঙ্গসংগঠন হিসেবে ‘ডেভকো’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। ডেভকোর মাধ্যমেই ঢাকায় বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বিকাশ লাভ করে। ১৯৩৩ সালে ঢাকার পরিবাগে ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ধানমন্ডি পাওয়ার হাউজ’ প্রতিষ্ঠা করে ডেভকো। সড়ক বাতি ছাড়া আবাসিক সংযোগও দেয়া হতো। মূল গ্রাহকগণ সবাই ছিলেন অভিজাত এলাকার বাসিন্দা। বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকা আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে গণ্য হতো। তবে সাশ্রয়ী ছিল বলে সাধারণ মানুষের মাঝে তখনও কেরোসিন বাতি জনপ্রিয় ছিল।
অবশেষে জ্বলল বিজলি বাতি
নবাববাড়িতে আলোকসজ্জার জন্য নতুন এক উপলক্ষ যুক্ত হলো। আড়ম্বরপূর্ণভাবে আয়োজিত হলো নবাব আহসানউল্লাহর পুত্র খাজা আতিকুল্লাহর বিয়ের অনুষ্ঠান। দিনটি ছিল ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর। বাংলায় সেবার হাড় কাঁপানো শীত। কিন্তু সে তীব্র শীত উপেক্ষা করে নগরবাসী উপস্থিত হলো আহসান মঞ্জিল প্রাঙ্গণে। মঞ্জিলের দোতলার বারান্দায় বসেছে অধিবেশন। ছোটলাট স্যার জন উডবার্নকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তিনি এসে বিদ্যুৎ প্রজ্জ্বলন করবেন, এমনটাই কথা ছিল। কিন্তু অসুস্থতার জন্য লাটসাহেব আসতে পারলেন না।
কলকাতা থেকে রাজস্ব বোর্ডের সেক্রেটারি চার্লস ওয়াল্টার বোল্টন এলেন প্রধান অতিথি হিসেবে। সভার মধ্যমণি হয়ে ঠিক মাঝখানে বসলেন তিনি। ডানদিকে আসন নিয়েছেন নবাব আহসানউল্লাহ। বাঁদিকে বসে আছেন পৌর কমিশনার। পাঁচটার দিকে শুরু হলো অধিবেশন। কমিশনার সাহেব ইলেকট্রনিক লাইট সম্পর্কিত প্রবন্ধ পাঠ করলেন। এরপর বক্তৃতা দিতে এলেন মিস্টার বোল্টন। নবাব আহসানউল্লাহর দানশীলতার প্রশংসা করলেন তিনি। বক্তৃতার এক অংশে বললেন পৌরসভার দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ার কথা, তাগাদা দিলেন জলনিষ্কাশন ব্যবস্থা উন্নত করার। সেইসাথে সরু, অপ্রশস্ত রাস্তাগুলোতে বিজলি বাতি মানাবে কি না, পৌরসভার কাছে সে প্রশ্নও রাখলেন।
এরপর এলো সেই বহুল প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। বোল্টন সাহেব একটি সুইচে চাপ দিলেন। মুহূর্তে জ্বলে উঠল উজ্জ্বল বাতি। তেল বা গ্যাস ছাড়া কোনো ‘অলৌকিক’ শক্তিতে বাতি জ্বলছে, সাধারণ মানুষের কাছে তখন তা এক বিস্ময়কর ব্যাপার। উপস্থিত সবাই সেদিন এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল। কেরোসিন বাতি আর চাঁদের আলোয় শহরের পথ-ঘাট দেখে অভ্যস্ত নগরবাসী প্রথমবারের মতো বিদ্যুতের আলোয় প্রিয় ঢাকাকে দেখল এক নতুন রূপে।
পরদিন ‘ঢাকা প্রকাশে’ ছাপা হলো-
“গতকল্য সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে, শ্রীযুক্ত নবাব বাহাদুরের অনুকম্পায় ঢাকা নগরীর প্রধান প্রধান রাস্তাগুলি চপলা চমকে অকস্মাৎ হাসিয়া উঠিয়াছে… ঢাকার ন্যায় শহরে এরূপ দৃশ্য লোকনয়নে নিপতিত হইবে দশ বৎসর পূর্বে বোধ হয় তাহা স্বপ্নের অগোচর ছিল কিন্তু নবাব বাহাদুরের অপার অনুগ্রহে অসম্ভবও সম্ভব হইয়াছে।”
সত্যিই নবাব আহসানউল্লাহর অনুগ্রহ না থাকলে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ এত দ্রুত বাস্তবায়িত হতো না। দুঃখের বিষয় হলো, এ আয়োজনের সপ্তাহখানেক পরেই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। তবে বিদ্যুৎ বাতির পেছনে নবাবের এই ব্যয় অনেকের কাছেই বিলাসিতা বলে মনে হয়েছিল। সাড়ে চার লক্ষ টাকার মতো বিশাল অঙ্ক নগর উন্নয়নের অন্যান্য খাতে ব্যয় না করে বিদ্যুতের জন্য খরচ করা উচিত হয়েছে কি না, তা নিয়ে পত্রিকায় উঠেছিল সমালোচনার ঝড়। নবাব যে পরিমাণ অর্থ গুটিকয়েক অভিজাত বাড়ি আর সড়ক আলোময় করতে খরচ করেছেন, তা কেরোসিন বা গ্যাস বাতির জন্য ব্যয় করলে হয়তো পুরো শহরকেই আলোকিত করা যেত। তবে যত সমালোচনাই থাকুক না কেন, ঢাকাবাসীর জন্য নবাব আহসানউল্লাহ সাক্ষাৎ প্রমিথিউস। প্রমিথিউস যেমন মানুষকে আগুন উপহার দিয়েছিলেন, নবাব আহসানউল্লাহ তেমনি ঢাকার মানুষকে এনে দিয়েছেন বিদ্যুৎ।
চাঁদের আলোর সাথে পাল্লা দিয়ে একদিন সড়কের এই বিজলি বাতিও যে নগর জীবনে প্রেমময় উষ্ণতা ছড়াবে, তা হয়তো সেদিন কেউ কল্পনাতেও ভাবেনি। সময়ের সাথে সড়ক বাতিগুলো বদলে গেছে। আশির দশকের সোডিয়াম বাতি বদলে এসেছিল হ্যালোজেন। সেই হ্যালোজেন বাতিও বদলে গিয়ে সড়ক দখল করেছে এলইডি বাতি। প্রযুক্তির উন্নতির সাথে একসময় হয়তো সড়কে রাত-দিন আলাদা করাই মুশকিল হয়ে যাবে। তবে আর যা-ই হোক না কেন, রাতের আঁধারে ঢাকার প্রথম অবগুণ্ঠন মেলে ধরার ইতিহাস রবে অভিন্ন। এ নগরের আত্মকাহিনীতে সে গল্প চিরকাল লিপিবদ্ধ থাকবে।