প্রায় আড়াই মাস হতে চলল বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা একটি সামরিক বিমানে চেপে দিল্লিতে এসে অবতরণ করেছিলেন। তারপর থেকে তাকে আর এক মুহূর্তের জন্যও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি, সোশ্যাল মিডিয়াতেও তার কোনও ছবি ‘লিক’ হয়নি, নানা কথিত ফোনালাপের অডিও ফাঁস হলেও সেগুলো যে তারই কণ্ঠস্বর তারও কোনও প্রমাণ মেলেনি। ভারতে এসে নামার পর থেকে তিনি যেন কার্যত হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন!
নিয়া দিল্লি থেকে বিবিসি বাংলার শুভজোতি ঘোষের লেখা প্রতিবেদনে জানা যায়, শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা, দিল্লিতে নামার পর থেকে কীভাবে আছেন, কোথায় আছেন তা নিয়ে ভারত সরকারের মুখপাত্র, মন্ত্রী বা নীতি-নির্ধারকরা আজ পর্যন্ত একটি শব্দও খরচ করেননি। কোনও সাংবাদিক সম্মেলনেও না, কোনও সাক্ষাৎকারেও না।
তবে ভারত সরকার ১৭ অক্টোবর বিকেলে আনুষ্ঠানিক ও পরোক্ষভাবে এটুকু শুধু জানিয়েছে যে তিনি এখনও ভারতেই অবস্থান করছেন। গত সপ্তাহে বিবিসি বাংলা যেমনটা জানিয়েছিল যে শেখ হাসিনার আমিরাত বা মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে যাওয়ার খবর সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, ফলে সেটুকু অন্তত এখন ভারত সরকারও অফিশিয়ালি ‘কনফার্ম’ করছে।
শেখ হাসিনার এ দেশে থাকা নিয়ে ভারত সরকার সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রাখতে সফল হয়েছে এটা যেমন ঠিক, তাকে কতদিন ভারতে রাখতে হবে সে ব্যাপারে দিল্লি কিন্তু এখনও পুরোপুরি অন্ধকারে। “ইট’স গোয়িং টু বি আ লং হল”, ব্যক্তিগত অভিমত জানাচ্ছেন দিল্লির সাউথ ব্লকের একজন শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা– যার ধারণা, বেশ লম্বা সময়ের জন্যই শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দিতে হবে এই বাস্তবতার জন্যই সরকার এখন ক্রমশ প্রস্তুত হচ্ছে।
তাহলে কি অতীতে যেভাবে তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামা বা আফগান প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর স্ত্রী-সন্তানদের ভারত ‘পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম’ বা রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল, শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবা হচ্ছে?
এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে দিল্লিতে বিবিসি বাংলা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তার ভিত্তিতে যে উত্তরটা পাওয়া যাচ্ছে তা মোটামুটি এরকম:
প্রথমত, ভারতের চোখে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা হলেন একজন ‘গেস্ট, বাট আন্ডার কমপালশন!’ অর্থাৎ তিনি রাষ্ট্রের একজন সম্মানিত অতিথি– যাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারতে চলে আসতে হয়েছে। এখন এই ‘অতিথি’র স্ট্যাটাসেই তাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এ দেশে রেখে দেওয়া যেতে পারে– ভারতের তাতে কোনও অসুবিধা নেই। দেশের পুরনো বন্ধু ও অতিথি হিসেবে তিনি সব প্রাপ্য সম্মানই পাবেন।
দ্বিতীয়ত, পরে পরিস্থিতি অন্যরকম হলে অন্য কিছু ভাবা যাবে– কিন্তু এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় বা অ্যাসাইলাম দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা ভারতের নেই। সবচেয়ে বড় কথা, তিনি নিজেও অ্যাসাইলামের জন্য কোনও আবেদন করেননি। কিন্তু যদি সত্যিই পরে সেরকম কোনও প্রস্তাব আসে, ভারত সরকার জানে এ ব্যাপারে দেশের সব দলই একমত হবে এবং শেখ হাসিনাকে অ্যাসাইলাম দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরি করা কোনও সমস্যাই হবে না। কিন্তু এখনই আগ বাড়িয়ে এরকম কোনও পদক্ষেপ দিল্লি নিতে চাইছে না।
গত ৫ই অগাস্ট সন্ধ্যা থেকে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় পর্যন্ত শেখ হাসিনা আগাগোড়া ভারতেই ছিলেন, ভারতেই রয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশে, বা আমিরাতের আজমান শহরে পাড়ি দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না– তৃতীয় কোনও দেশে যাওয়ার জন্য তিনি বিমানেও চাপেননি। বিমানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে তাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হয়েছে, এ খবরও সম্পূর্ণ অসত্য।
৫ই অগাস্ট সন্ধ্যায় দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের হিন্ডন বিমানঘাঁটিতে এসে নামলেও পরবর্তী দু’তিনদিনের মধ্যেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, এটাও নিশ্চিত। হিন্ডন মূলত ভারতীয় এয়ারফোর্সের একটি বেস, সেখানে একজন ভিভিআইপি অতিথির লম্বা সময়ের জন্য থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। কাজেই শেখ হাসিনাকে সেখানে থেকে অন্য লোকেশনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে প্রথম সুযোগেই।
শেখ হাসিনা যাতে প্রয়োজনে তৃতীয় কোনও দেশে সফর করতে পারেন, এই জন্য ভারত সরকার তাকে ‘ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’ (টিডি) দিয়েছে– এই মর্মেও সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ভারত সরকার কিন্তু ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট নিয়ে মন্তব্য এড়িয়ে গেছে– বিষয়টি স্বীকার বা অস্বীকার কিছুই করেনি। ফলে শেখ হাসিনা ভারতের কাছ থেকে টিডি পেয়েছেন, এটাও নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
শেখ হাসিনা এখনও ভারতেই আছেন, সরকার এটা কনফার্ম করলেও তিনি রাজধানী দিল্লিতেই আছেন কি না– সেটা কিন্তু নিশ্চিত নয়।
শেখ হাসিনা ঠিক কোথায় থাকতে পারেন, তা নিয়ে দু’রকম জল্পনা শোনা যাচ্ছে –
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দিল্লিতে কর্মরত মেয়ে সাইমা ওয়াজেদের বাসভবনে তার সঙ্গেই শেখ হাসিনাকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে আর
- দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের মীরাট বা হরিয়ানার মানেসরে একটি আধাসামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ তিনি থাকছেন। বিবিসি বাংলা আভাস পেয়েছে, এর মধ্যে প্রথমটির কোনও ভিত্তি নেই– কিন্তু দ্বিতীয় জল্পনাটি সত্যি হলেও হতে পারে।
শেখ হাসিনাকে গত আড়াই মাসের মধ্যে দিল্লির বিখ্যাত লোদি গার্ডেনে মর্নিংওয়াক করতেও দেখা যায়নি, তিনি রাজধানীর কোনও সুপারস্টোরে কেনাকাটাও করতে যাননি। এগুলো শতকরা একশভাগ গুজব– এই সব দাবির স্বপক্ষে কেউ কোনও ছবিও দেখাতে পারেনি, কেউ তাকে ওসব জায়গায় নিজের চোখে দেখেছে এমন দাবি নিয়েও এগিয়ে আসেনি।
শেখ হাসিনাকে কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে খুবই ‘সেফ’ কোনও লোকেশনে রাখা হয়েছে, তিনি নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারছেন না– এটা যেমন ঠিক, তাকে ‘গৃহবন্দি’ বা হাউস অ্যারেস্টে রাখা হয়েছে বলাটাও কিন্তু সমীচিন নয়। প্রমাণ হিসেবে বলা চলে, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ফোনের অ্যাকসেস ঠিকই বহাল আছে, আমেরিকা বা দিল্লিতে অবস্থানরত নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এমনকি, দলের যে নেতা-কর্মীদের কাছে তার ব্যক্তিগত টেলিফোন নাম্বার ছিল তারাও অনেকেই তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন এবং কথাবার্তাও বলেছেন।
তবে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে ভারতে আসতে হয়েছে, তারপর যে কোনও অতিথিকেই কিছু ‘ডিব্রিফিং সেসনে’র মধ্যে দিয়ে যেতে হয়– এবং শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এখন তার কাছ থেকে ভারত কী ধরনের ‘ডুজ অ্যান্ড ডোন্টস’ প্রত্যাশা করছে, তার কোনটা বলা উচিত বা কোনটা বলা উচিত নয় বলে মনে করছে– এই সব সেসনে ভারতের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তাকে সে ব্যাপারে ব্রিফ করেছেন এবং তার কাছ থেকেও ‘নোটস’ নিয়েছেন– বিবিসি এটাও নিশ্চিতভাবেই জানতে পেরেছে।
তবে এতসব কিছু ছাপিয়ে দিল্লিতে সদ্যসমাপ্ত দুর্গাপুজোর প্রাঙ্গণে বাঙালিদের আড্ডায় সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা ছিল, শেখ হাসিনা কি এবারে ইলিশের ভরা মরশুমে বাংলাদেশের ইলিশ খেতে পেলেন? তাকে নিয়ে অন্য অনেক প্রশ্নের মতো এটারও উত্তর রহস্যে মোড়াই থেকে গেছে!