লোদি রাজবংশের শাসন ১৪৫১ থেকে ১৫২৬ সাল পর্যন্ত দিল্লি সালতানাতের শেষ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। লোদি শাসকগণ আফগান বংশোদ্ভুত ছিলেন এবং তাদের শাসনপদ্ধতি তুর্কি শাসকদের থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। তাদের শাসনামলে প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিবর্তন আনা হলেও, শেষ পর্যন্ত লোদি রাজবংশের পতন ঘটে এবং মুঘলদের আধিপত্য শুরু হয়। লোদি শাসনের অবসানের প্রধান কারণ হিসেবে দুর্বল সামরিক কৌশলকে দায়ী করা হলেও, এর পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে।
লোদি রাজবংশের উত্থান
লোদি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাহলুল লোদি, যিনি ১৪৫১ সালে দিল্লির সুলতান হন। বাহলুল লোদি তার শাসনামলে আফগান সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিভিন্ন বিদ্রোহ দমন করে সাম্রাজ্যকে স্থিতিশীল করেন। তার পরবর্তী শাসক সিকান্দার লোদি দিল্লি সালতানাতকে আরও বিস্তৃত করেন এবং প্রশাসনিক সংস্কার সাধন করেন।
ইব্রাহিম লোদি ও দুর্বলতা
লোদি রাজবংশের শেষ শাসক ছিলেন ইব্রাহিম লোদি, যিনি ১৫১৭ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার শাসনামল ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং সামরিক চ্যালেঞ্জে পূর্ণ। ইব্রাহিম লোদি শাসনের শুরু থেকেই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ এবং আঞ্চলিক শাসকদের অসন্তোষের সম্মুখীন হন। তিনি তার শাসনামলে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা অনেক আঞ্চলিক শাসকের বিরোধিতার কারণ হয়।
সামরিক কৌশলের দুর্বলতা
ইব্রাহিম লোদি সামরিক কৌশলে উল্লেখযোগ্য দুর্বলতা প্রদর্শন করেন, যা তার শাসনের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। তার সেনাবাহিনী বিশাল হলেও, তাদের মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব ছিল। এছাড়া, ইব্রাহিম লোদি তার সেনাপতিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, যা সেনাবাহিনীর মনোবলকে দুর্বল করে তোলে। তিনি নিজেও একজন দক্ষ সামরিক নেতা ছিলেন না, যার ফলে তার নেতৃত্বে সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে পরিচালিত হয়নি।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধ
১৫২৬ সালে কাবুলের শাসক জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লি আক্রমণ করেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদি এবং বাবরের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। যদিও লোদি বাহিনী সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল, তবুও বাবরের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং কৌশলগত দক্ষতার সামনে তারা টিকতে পারেনি। বাবরের কামানের ব্যবহার এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তার সেনাপতিদের দক্ষ নেতৃত্ব লোদি বাহিনীকে পরাজিত করে। ইব্রাহিম লোদি এই যুদ্ধে নিহত হন এবং এর মধ্য দিয়ে লোদি রাজবংশের অবসান ঘটে।
অন্যান্য কারণ
দুর্বল সামরিক কৌশল ছাড়াও লোদি রাজবংশের পতনের পেছনে আরও কিছু কারণ ছিল। ইব্রাহিম লোদি তার আঞ্চলিক শাসকদের সাথে সঠিকভাবে সম্পর্ক বজায় রাখতে ব্যর্থ হন, যা বিভিন্ন বিদ্রোহের জন্ম দেয়। তার কঠোর নীতিমালা এবং শাসনপদ্ধতি অনেক শাসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এছাড়া, তুর্কি এবং আফগান অভিজাতদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতার লড়াই লোদি সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে তোলে।
উপসংহার
লোদি রাজবংশের পতন এবং মুঘল সাম্রাজ্যের উত্থান উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। যদিও দুর্বল সামরিক কৌশল লোদি শাসনের অবসানে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে, তবে এর সাথে যুক্ত ছিল অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং শাসনের অদক্ষতা। ইব্রাহিম লোদি তার সাম্রাজ্যকে একত্রিত রাখতে এবং বহিরাগত আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যর্থ হন, যার ফলে তার শাসনের পতন ঘটে এবং মুঘল শাসনের পথ প্রশস্ত হয়।