বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সময়ের পরিক্রমায় রূপ নেয় সরকার বিরোধী আন্দোলনে। ছাত্রদের ডাকে সাড়া দেয় পুরো দেশ। ঘটে যায় ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। পতন হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসকের। পতন হয় দেশের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ-এর।
দেশব্যাপী আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে সর্বস্তরের জনগণ। শহর থেকে গ্রামে বাজতে থাকে জয়ডঙ্কা। মিষ্টি বিতরণ হয় খুশিতে। অনেকেই বিজয়ের নাম দেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। প্রচারও করেন ২৪ এর স্বাধীনতা হিসেবে। আনন্দের আতিশয্যে হুট করেই জনমনে প্রশ্ন জাগে ‘কে হবেন পরবর্তী সরকার প্রধান?’ কে ধরবেব দেশের হাল?
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উৎকন্ঠা। ছাত্রজনতার পরামর্শে অবশেষে সেই উৎকন্ঠার অবসান হয় শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের মাধ্যমে। এই নিয়োগ সমর্থন পায় দেশের আপামর জনসাধারণের। সকলেই এক বাক্যে তার ‘প্রভুত্ব’ মেনে নেয়।
এবার শুরু হয় আশা-আকাঙ্ক্ষার পালা। হিমালয় সমান আশার স্তূপ ঠেলে দেয়া হয় ড. ইউনূসের সামনে। জনগণের আশার বাতিঘর হয়ে ওঠেন সর্বজনগৃহীত এই সরকার প্রধান। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ১৬ বছর ধরে বুকে চেপে থাকা দাবির ফুলঝুরি একে একে উঠে আসে ৷
এখন প্রশ্ন উঠেছে ক্ষমতার মসনদে বসার ১ মাসের বেশি সময় অতিক্রম করেও ইউনূস সরকার কতটা আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পেরেছেন? কতটাই বা কার্যকরভাবে জনতার সরকার হয়ে উঠতে পেরেছেন? বা কতটুকুই বা সে পথে পা বাড়াতে পেরেছেন?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত কী কী করেছে বা উদ্যোগ নিয়েছে সে তালিকাটা চেখে দেখা যাক।
আহা, তালিকা তো খালি! নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না জনগণ। নাগরিক টেলিভিশন চেষ্টা করছে সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপ নিয়ে সারা বাংলাদেশের জনসাধারনের মতামতের প্রতিফলন প্রতিনিয়ত তুলে ধরতে। প্রধান উপদেষ্টার ভাষায়, ‘মন খুলে সমালোচনা করুন’।
সাধারণ জনগনের দৈনন্দিন জীবনে চোখে পড়ার মত তেমন কিছুই পাইনি আমরা এখনো! লেখার যেন কিছুই নেই! সব সুরের প্রথম স্বরেই গাওয়া “আপনারা অপেক্ষা করুন, দেখুন আমি কী করি, তারপর বিচার করবেন”। কিন্তু এই একই স্বর দিয়ে আর কতদিন শ্রতাদর্শক ধরে রাখা যাবে?
তারা তো একই মঞ্চে জড়ো হয়েছেন একটা সুমধুর ‘সুরাগমের’ প্রতীক্ষায়। অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছেন কখন বেজে উঠবে সেই সুমধুর তান! যে মধু গত ১৬ বছরে ঢালা হয়নি, সে মধুর চাক কখন ভাঙ্গা হবে!
কিন্তু না, মাস পেরিয়ে নতুন মাস এলো, কোনো মধু বা মিষ্টান্নের দেখাও পাননি দেশবাসী। এখন পর্যন্ত যা পাওয়া গেলো, তা মধু না কিছুটা আঁশটে গন্ধযুক্ত অপ্রকাশিত মাকাল ফলের আঁটি।
জনগণ কী কী আশা করছে তার তালিকাটা ঘুরে আসা যাক। আমরা হতবাক, এই তালিকা তো পড়ে শেষ করার সাধ্য কারো নাই! একদল চাইছে সূর্য পূর্ব দিকেই উঠবে, আরেকদল কড়া হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সূর্য যেনো আর কোনোদিনও পূর্বে উঠতে না পারে।
একদল বলছে সরকার দক্ষিণ দিকে হেলে থাকবে, আরেকদল বলছে সরকার কখনোই দক্ষিণ দিকে ফিরতে পারবে না।
এভাবেই একই বিষয়ের উপর বহুমাত্রিক চাওয়ার সমাহার। যা পূরণ করতে গেলে বরং অসন্তোষ আরো বেড়ে যাবে। কারণ একদলের অধিকার পূরণের সাথে আরেক দলের বঞ্চিত হওয়া জড়িত।
কিন্তু মূল কথা হলো সরকারের আসলে করণীয় কী ছিলো? সরকার কি মানুষের এইসব নানামুখী চাহিদা শুধুই শুনে বেড়াবে উত্তর হলো: ‘না’। সরকারের অনেককিছু করণীয় রয়েছে। যা একেবারেই প্রাথমিক এবং আবশ্যকীয় কাজ। যেমনঃ প্রথমেই সরকারের উচিত ছিলো আন্দোলন পরবর্তী সময়কালীন আইনশৃঙ্খলা সুদৃঢ় করা।
আন্দোলন চলাকালে বা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা আশংকাজনকভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপর মানুষ আস্থা হারায় এবং তাদের উপর চরমভাবে ক্ষিপ্ত হয়। ফলে দেশের অধিকাংশ থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়ার পাশাপাশি শত শত পুলিশকে আক্রমণ করা হয়। সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূনর্গঠনে দ্রুত কোনো অগ্রগতি দেখাতে পারেনি।
রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রতিহিংসা দমনে শক্তহস্ত হওয়ার কথা ছিলো প্রধান উপদেষ্টার। প্লেন থেকে নেমেই তিনি বলেছিলেন যে, আমি দায়ীত্ব নিতে রাজি আছি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বেশ দৃঢ় স্বরেই বলেন, ‘আমার কথা শুনতে হবে। প্রতিহিংসা বন্ধ করতে হবে আগে।’
বিগত সরকারের পতনের পর দেশে লাখ লাখ ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুটপাট ও পুড়িয়ে ফেলা হয়। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ক’দিন পরই এই সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। বেশকিছু মানুষ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়। কিন্তু জেনারেশন ‘জি’ -এর আন্দোলন পরবর্তী সময়ে এমন হওয়ার তো কথা ছিলোনা!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনার পরিবেশ তৈরি করে ছাত্রশিক্ষকদের পাঠগ্রহণ ও পাঠদানে ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়টিতে বর্তমান সরকার একেবারেই অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনের ফলেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। এখন তাদের কাজ নিজের ক্যাম্পাসে ফিরে যাওয়া। পড়াশুনায় মনোনিবেশ করা।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনই নিত্যনতুন কর্মসূচি দিয়ে দেশের বিশৃঙ্খলা উস্কে দিচ্ছে৷ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাথার মণি শিক্ষার্থীরা এখন দিনেদিনে সাধারণ জনগণের বিরাগভাজন হতে শুরু করেছে। অনেকেই তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করছে প্রকাশ্যেই। নানারকম মন্তব্যও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ ও বর্তমান সরকারের জন্য অশনিসংকেত।
পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনীতির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে৷ বিগত কয়েক সপ্তাহে কারখানায় কারখানায় আন্দোলন-ধর্মঘট উৎপাদনকে আশঙ্কাজনকভাবে ব্যহত করেছে। সময়মত শিপমেন্ট হয়নি বিদেশি অর্ডারের। কেউ কেউ ধারণা করছেন প্রায় ৩০ শতাংশ অর্ডার ক্যান্সেল হওয়ার পথে। পোশাক শিল্প সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারের অগ্রাধিকার আগের থেকেই থাকার প্রয়োজন ছিলো।
ধরা হচ্ছে দেশে আর কোনো ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট নাই। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্যের দাম বেশ কিছুটা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো দাম কমেনি, প্রায় সব দ্রব্যমূল্যের দাম আগের মতোই রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রে বরং তা আরো বেড়েছে। ভারতে ইলিশ পাঠাবোনা বলে – উপদেষ্টা জনসাধারণের বাহবা নিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু ইলিশের দাম পূর্বের তুলনায় আরো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বেড়ে গেছে। ধানের মূল্য বেড়েছে বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা।
আমদানি রফতানিও পুরোদমে সচল হয়নি। দেশ এখন চলছে রিজার্ভ পণ্য দ্বারা। সীমিত আকারে আমদানি হলেও তা মোটেই যথেষ্ট নয়। রফতানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে উৎপাদন যন্ত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে উৎপাদন ব্যহত হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশগুলো, বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য আমদানিতে আমরা ভারতের উপর ব্যপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পরেছি বিভিন্ন সময়ে। কিছু অপপ্রচারের ফলে দু’দেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হচ্ছে বৈরিতা। যার প্রভাব কূটনীতিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা৷ যার ফলে ভারত থেকে আমদানি করা পণ্যেও ভাটা পড়েছে অনেক ক্ষেত্রে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এই ব্যপারে আলোচনা না করলে সরকার অচিরেই খাদ্য সঙ্কটে পড়তে পারে বলে ধারণা করছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।
হাসিনা সরকারের রাজনীতিকরণ স্থানীয় সরকার পর্যন্ত ব্যাপকভাবে বিস্তৃত ছিলো। ফলে সরকার পতনের সাথে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে স্থানীয় সরকার। অনেক প্রতিনিধি দিয়েছেন গা ঢাকা। এই ব্যপারে বর্তমান সরকার দৃষ্টিপাত ঠিকমতো না করায় ভেঙ্গে পড়েছে স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা৷ ফলে স্থানীয়ভাবে বিশৃঙ্খলার খবর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ এড়াতে পারেনা।
বিগত সরকারের সবচেয়ে সমালোচিত উদ্যোগগুলোর অন্যতম ছিলো নতুন শিক্ষানীতি। নতুন পাঠ্যসূচি নিয়ে সকলেরই অসন্তোষ ছিলো। কিন্তু বর্তমান সরকার তার সংস্কারের তালিকায় শিক্ষানীতিকে সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলে ‘নতুন শিক্ষানীতি’ নিয়ে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
গণমাধ্যমগুলোতে এখনো বস্তুনিষ্ঠ কোনো খবর চোখে পড়ছেনা। আন্দোলন পরবর্তী শিক্ষার্থীদের ‘ক্লিন কালপ্রিট’ অভিযানের কারণে একটা ভীতিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। যার প্রভাব মিডিয়াপাড়ায়ও পড়েছে। ফলে অনেকেই এখনো সরকারের সমালোচনা বা দেশের প্রকৃত অনেক ঘটনা নিয়েই সংবাদ তৈরির ঝুঁকি নিতে চাইছেন না। যা কোন কালেই দেশ ও সরকারের জন্য মোটেও মঙ্গলজঙ্ক নয়৷
নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করা: রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে দোষী মানুষের পাশাপাশি অনেক নির্দোষ মানুষ হামলা, লুটপাট ও মামলার শিকার হয়েছে, এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
সরকারের লক্ষ্য এখনো সুস্পষ্ট করা হয়নি। সরকার এখনো সেভাবে তাদের কোন ‘রোডম্যাপ’ জনসমক্ষে পেশ করেনি। তারা কী করতে চায়, কী তাদের কর্মপরিকল্পনা সে ব্যপারে রয়েছে ধোঁয়াশা।
এছাড়াও আরো অনেক বিষয়ে কথা বলা যাবে যেখানে বর্তমান সরকারের সাফল্য-ব্যার্থতা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। সাধারণ মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উপর যতটা আস্থা রেখেছে, প্রধান উপদেষ্টা কি আদৌ এখনও তাদের আশার বাতিঘর হতে পেরেছেন? না পারার পথে রয়েছেন?