‘৭১-এর ডিসেম্বরে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে সবার আগে স্বীকৃতি দেয় এবং সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরান্বিত করেছিল। আর পাকিস্তান আবার বাংলাদেশের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে এবছরের ডিসেম্বরে থেকেই।
ডিসেম্বরেই ভারতের মাটিতে হামলার শিকার হলো বাংলাদেশ মিশন। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানো হয়েছে।
ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলা এবং পতাকা পোড়ানোর পর দিল্লিকে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিরোধী সমস্ত রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন ও ছাত্রদের সাথে নিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের মর্যাদা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গত দেড় দশকে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক যে উচ্চতায় পৌঁছানোর কথা বলা হতো, ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনার সঙ্গে পতন হয়েছে সেই সম্পর্কেরও। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা বন্ধ। জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি হয়েছে। এসব কিছু নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেছে বিবিসি।
ভারতের উদ্বেগ
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের ভারত বিরোধী একটা অবস্থান এবং এর বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে। ভারতের সেভেন সির্স্টার্সকে টার্গেট করে বক্তব্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় হুঁশিয়ারি প্রচার হওয়ায় উদ্বেগ ও উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ভারতে।
ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশ নিয়ে গবেষণা করছেন বহু বছর ধরে। শ্রীরাধা দত্ত অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ সরকার প্রসঙ্গে ভারতের ভাবনা সম্পর্কে বিবিসিকে বলেন “ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাংবিধানিক গুরুত্ব তো তেমন জোড়ালো নয়। আর তাছাড়া এই সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়য়ে আসেনি।”
“বাংলাদেশে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাইনা। তবে নিঃসন্দেহে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের একটা স্বস্তি তো কাজ করতোই। সেই স্বস্তির সুযোগটা মনে হয় কোথাও সরে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগ চলে যাওয়াতে ভারতের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে যে ভারতের নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাংলাদেশের অন্য কোন সরকার সম্ভবতঃ বুঝবে না। সেটার একটা প্রেক্ষাপট আছে। যেমন ২০০১ থেকে ২০০৬ এই সময়টিতে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে সম্পর্কটা ছিলো সেটা দুই দেশের ত্রিশ বছরে সবচেয়ে খারাপ ছিল।”
তিনি বলেন, “সেটার কারণ অনেকগুলো। তার মধ্যে সবচেয়ে সমস্যা ছিল উগ্র তৎপরতা, সন্ত্রাশী আক্রমণ। এধরনের উগ্রতা যে শুধুমাত্র বাংলাদেশের ভেতর থেকেই হয়েছে তা না, বহিঃর্বিশ্বের অন্যান্য শক্তি চেষ্টা করেছে তার তথ্য আমাদের কাছে আছে।”
সরকার পতনের পর অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে ভারত যে যে বার্তা পেয়েছে সেটি নিয়ে তাদের অস্বস্তি আছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারণ বর্তমান সরকারের সময়ে পাকিস্তান থেকে সরাসরি পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশে এসেছে।
“যখন পাকিস্তান আবার বাংলাদেশের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে যাচ্ছে তার মানে তারা আবার চেষ্টা করবে যে কী করে ভারত বিরোধী কিছু কার্যক্রম বাংলদেশকে দিয়ে করানো যায়। এরকম অনেক আশঙ্কা রয়েছে। যেটা গত একশ’ বছরে হয়নি, জিন্নাহর জন্মদিন সেলিব্রেট করা করেছে।”
পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে ভিত্তিহীন তথ্য, নানারকম গুজব ছড়াতে দেখা গেছে বলে বিবিসি নিশ্চিত করেছে।
বিবিসির ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে অভ্যুত্থানের পর থেকে ভারতীয় গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য এবং গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখা গেছে।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, “আমরা কোনভাবেই নিশ্চিত হতে পারছি না যে ওখানে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। মানে কোথাও যেন মনে হচ্ছে সরকার ম্যানেজ করতে পারছে না।”
দু’দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ধর্ম নিয়ে যেটা চলছে সেটা খুবই স্পর্শকাতর।
বাংলাদেশের অবস্থান
ভারতের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিবিসি ব্যাখ্যা করেছে এভাবে; আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার পর ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের মাঝে। ঢাকায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন আলাদা আলাদা কর্মসূচি দিয়েছে, প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেছে।
বিবিসি উল্লেখ করে, মঙ্গলবার শাহবাগে বিক্ষোভ সমাবেশ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত প্রতিবাদী মিছিল করে জাতীয় নাগরিক কমিটি। গণঅভ্যুত্থানের নেপথ্যে থাকা গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তি ভেঙে দিয়ে নতুন এ সংগঠনটি তৈরি হয়েছে।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলে সামনের সারিতে অংশ নেয়া বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের নেতারা বলেন, সীমান্ত হত্যা, পানির হিস্যা বিভিন্ন ইস্যুতে আওয়ামী লীগ সরকারের একটা নতজানু নীতি ছিল।
তরুণরা জোর দিয়ে বলে, “আগের মতো যে তাদের (ভারত) অধীনস্ত বা তাদের আধিপত্য এটা এখন আর থাকবে না। আমরা কিন্তু তাদের সাথে শত্রুতা চাই না। আমরা তাদের সাথে সমান সমান বন্ধুত্ব চাই।”
বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সেটি অনেক ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখা হচ্ছে বাংলাদেশে। ভারতে জনগণ এবং সরকার এবং জনগণ যেভাবে বাংলাদেশকে দেখছে সেটির সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই বলেও বাংলাদেশ দাবি করছে। এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় বিভিন্ন কূটনীতিক মিশন ও রাষ্ট্রদূতদের ব্রিফিং করেছে সরকার।
দু’দেশের জনগণের সম্পর্ক
ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনের সবচে উদ্বেগের বিষয় হলো ভারত-বাংলাদেশ জনগণের মধ্যে সম্পর্কের চরম অবনতির দিকটি বলছে বিবিসি।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির মনে করেন দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের এই নেতিবাচক অবস্থাটি নজিরবিহীন।
এম হুমায়ুন কবির বলছেন জনগণের পর্যায়ে সম্পর্কের যে উত্তেজনা তারই প্রতিফলন হলো ভারতে বাংলাদেশ মিশনে হামলা এবং বাংলাদেশ জুড়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ।
“দুই দিকেই কেমন যেন একটা সাজ সাজ রব মনে হচ্ছে এবং সেটা প্রধানত জনগণ পর্যায়ে। জন উত্তেজনার একটা নতুন জায়গা তৈরি হয়েছে যেটা কিন্তু আশঙ্কার কারণ। কেন আশঙ্কা? কারণ হলো, এতে করে ভারতে বাংলাদেশিদের কোনো হোটেলে থাকতে দেওয়া হচ্ছেনা। সীমান্তে এসে ভারতীয়রা বিচ্ছিন্নভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে বা বাংলাদেশে ঢুকবার চেষ্টা করছে, পণ্যসামগ্রী আদান প্রদানে বাধা প্রদানের চেষ্টা করছে।”
সার্বিকভাবে দুদেশের সম্পর্কের গতি প্রকৃতি এখন নেতিবাচক বার্তাই দিচ্ছে বলে বিবিসিকে বলেন এম হুমায়ুন কবির।