রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের ভবিষ্যৎ কী?
রাষ্ট্র ‘সংস্কার’ এবং ‘ফ্যাসিবাদ’ বিতাড়ণের হাওয়ায় এবার রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি প্রবল রূপ নিয়েছে।শেখ হাসিনা উৎখাতে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি সংগঠন রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে। বঙ্গভবনের সামনে গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে বিক্ষোভ, নাটকীয়তা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ওই দাবির কথা বলতে শুরু করেছিলেন অক্টোবরের শুরুতেই। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগের’ বিষয়টি নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের এক বক্তব্য সামনে আসার পর এখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারাও একই ধরনের ভাবনার কথা বলতে শুরু করেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, অন্তর্বর্তী সরকার কি চাইলেই রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করতে পারে?
সংবিধান বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা বলছেন, সংসদ যেহেতু কার্যকর নেই, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতে থেকে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সম্ভব না।
তবে তাকে বিদায় করা অসম্ভবও না। তেমন মনে করলে সরকার রাষ্ট্রপতিকে চলে যেতে বলতে পারে। রাষ্ট্রপতি নিজেও পদত্যাগ করতে পারেন। সরকার তখন নতুন কাউকে রাষ্ট্রপতি করতে পারে। তবে বর্তমান সংবিধানে থেকে সেটা সম্ভব নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসন অবসানের পর প্রশাসনের শীর্ষ পদের অধিকারীরা বদলে গেলেও ‘অনিবার্য’ কারণে রাষ্ট্রপ্রধানের পদে রয়ে গেছেন মো. সাহাবুদ্দিন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ গত ৩ অক্টোবর এক ফেইসবুক পোস্টে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি সামনে আনেন। পরে আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলমও একই দাবির কথা ফেইসবুকে বলেন।
এর মধ্যেই নতুন এক আলোচনা ঘিরে সেই দাবি ফের জোরালো হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে উড়ে যাওয়ার আগে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন কি না- আড়াই মাস পর হঠাৎ সেই বিতর্ক সামনে এসেছে রাষ্ট্রপতির এক মন্তব্যের কারণে।
আর ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মো. সাহাবুদ্দিন ‘শপথ ভঙ্গ করেছেন’ দাবি করে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মনে করিয়ে দিয়েছেন, এরপরও তাকে রাষ্ট্রপতি পদে রাখা চলে কি না, তা বিবেচনার সুযোগ সংবিধানে আছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তবে তার আগেই তিনি পদত্যাগ করে ফেলায় সেই পথে আর হাঁটেনি সংসদ।
২০০১ সালের নভেম্বরে বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে ২০০২ সালে অপসারণের উদ্যোগ নেয় তখনকার সরকার। সংসদে সেই প্রস্তুতির মধ্যে ২০০২ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি।
সংবিধানে কী আছে
সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ-সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।
৫০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি কার্যভার গ্রহণের তারিখ থেকে পাঁচ বছর তার পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।
৫২ অনুচ্ছেদে সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসন করার সুযোগ আছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নানা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে এবং সংসদের কমপক্ষে দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন লাগবে।
৫৩ অনুচ্ছেদে শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণের যে কথা বলা আছে, সেখানেও সংসদের দুই তৃতীয়াংশ সমর্থনের শর্ত আছে।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন জানানোর পর ৬ অগাস্ট রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে দেন। ফলে সংসদে অভিসংশনের কোনো সুযোগ এখন নেই বলে মন দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
অপসারণের সুযোগ কোথায়?
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক এক টকশোতে বলেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে এখন অপসারণ করা যাবে না।
তিনি বলেন, “যুদ্ধাবস্থা হলে রাষ্ট্রপতি সংসদ পুনর্বহাল করতে পারেন। কিন্তু এখন তো যুদ্ধাবস্থাও নয়।”
আরেক আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বা অভিসংশনের আর এখন কোনো আইনি পন্থা নেই।
“রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে করতে পারেন।…সংবিধানে বলা আছে। না, আর কোনো সুযোগ নেই এখন।”
এমনকি এখন রাষ্ট্রপতির অপসারণ বিষয়ে আদালতের মতামত চাওয়ারও কিছু নেই বলে মনে করেন এই আইনজীবী।
তিনি বলেন, “আদালতে মতামত চাওয়ার বিষয়টি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে। সেটা হল- কোনো আইন নিয়ে যদি কোনো ব্যত্যয় বা ব্যাখ্যার দরকার হয়, বোঝা যাচ্ছে না- সেখানেই কেবল রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের কাছে মতামত চাইতে পারেন।”
সোমবার সচিবালয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, “রাষ্ট্রপতি বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র পান নাই, এটা হচ্ছে মিথ্যাচার, উনার শপথ লঙ্ঘনের সামিল।…উনি যদি উনার বক্তব্যে অটল থাকেন, তাহলে উনি রাষ্ট্রপতি পদে থাকার যোগ্যতায় আছেন কি না, সেটা আমাদের উপদেষ্টামণ্ডলীর সবাইকে ভেবে দেখতে হবে।”
কিন্তু উপদেষ্টা পরিষদের কি এ বিষয়ে কিছু করার ক্ষমতা আছে?
এ বিষয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, “ভাবতে পারেন। তবে উপদেষ্টা পরিষদ তো রাষ্ট্রপতির কাছেই শপথ নিয়েছেন। তারা তো রাষ্ট্রপতিকে একসেপ্ট করে নিয়েছেন। ভাববে বলতে তারা দেখবে রাষ্ট্রপতিকে তারা চাচ্ছে কি চাচ্ছে না- এসব নিয়ে ভাবার তো সুযোগ আছে। উপদেষ্টা পরিষদ কেন, যে কোনো মানুষই ভাবতে পারে। যাদের ক্ষমতা আছে তারা ভাবতে পারেন। কিন্তু কিছু করার নেই।
“রাষ্ট্রপতিকে ইমপিচ বা অভিসংশন করতে পারবেন অথবা তিন নিজে পদত্যাগ করতে পারেন। এ দুটোই পদ্ধতি।”
এখন তো সংসদ নেই। তাহলে এই অবস্থায় রাষ্ট্রপতিকে কীভাবে অপসারণ করা যায়? এ প্রশ্নে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী বলেন, “পদত্যাগ করতে হবে।”
পদত্যাগ না করলে কী করতে হবে?
তিনি বলেন, “পদত্যাগ করতে বলতে হবে।” সেটা কে বলবে? “উপদেষ্টাদের কেউ বলবেন। উপদেষ্টা পরিষদে প্রস্তাব নিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বলতে হবে। এরপর আরেকজনকে রাষ্ট্রপতি করবেন। তাকে প্রধান উপদেষ্টা শপথ পড়াবেন।”
কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষমতা তো সংসদের। এখন সংসদ নেই, তাহলে নতুন রাষ্ট্রপতি হবে কী করে?
এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এখন তো সাংবিধানিক সরকার নেই। এটা বিপ্লবী সরকার। এখন সবকিছু সংবিধান মেনে চলবে না। কিছু সংবিধান মেনে চলবে, কিছু মেনে চলবে না। সংবিধানের স্পিরিটে কাজটা করতে হবে। এটা জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী হবে।”
তবে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, বর্তমানে সংবিধান বহাল থাকায় আইনি বিষয় ছাড়া অন্য কোনো বিষয় এখন আলোচনা করে লাভ নেই।
গত ৮ অগাস্ট মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান অনুযায়ী এবং সংবিধান মেনে চলার অঙ্গীকার করেই শপথ নেয়।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলেই বা কী হবে
রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করেন বা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকেন বা দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হন, তাহলে কী হবে, সেটিও সংবিধানে লেখা আছে।
নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত বা রাষ্ট্রপতি আবার কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করবেন স্পিকার।
কিন্তু গত ২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগ করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। তার অবর্তমানে যিনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন, সেই ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ১৫ অগাস্ট।
অবশ্য সংবিধানের ৭৪(৬) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে তখন কী হবে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী জেড আই খান পান্না বলেন, “কেন, নতুন রাষ্ট্রপতি ছাত্ররা বানাবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা তো বলেছেন, ছাত্ররাই তাকে বানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতিকেও বানাবে।”
স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ইতোমধ্যে পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পর আর তার ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন পান্না।
হঠাৎ বিতর্ক কী নিয়ে
তুমুল গণ আন্দোলনের মুখে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা ভারতে উড়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম এবং আরও কয়েকটি দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা দেশত্যাগের আগে পদত্যাগ করেছেন।
সেই রাতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তিন দিন পর মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শপথ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
কয়েকদিন পর শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় একটি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তার মা পদত্যাগের সুযোগ পাননি। পরে ফাঁস হওয়া এক টেলিফোন আলাপেও শেখ হাসিনাকে ওই কথা বলতে শোনা যায়।
এরই মধ্যে শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত জুলাই ও অগাস্টে সংঘাতে প্রাণহানিকে ‘গণহত্যা’ বিবেচনা করে এই বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নতুন আলোচনা শুরু হয় গত ১৯ অক্টোবর মানবজমিন পত্রিকার রাজনৈতিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’ এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ‘উনি তো কিছুই বলে গেলেন না…’ শিরোনামে সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর।
সেখানে মানবজমিন সম্পাদক লেখেন, “প্রশ্ন উঠেছে প্রধানমন্ত্রী যদি পদত্যাগ করে থাকেন তাহলে সেটা গেল কোথায়? কারও কাছে এই প্রশ্নের জবাব নেই। ‘তিন সপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েছি। খোঁজ নিয়েছি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগেও। যেখানটায় প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র থাকার কথা। কোথাও নেই।”
শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির মুখোমুখি হন মতিউর রহমান চৌধুরী। তিনি প্রশ্ন রাখেন, “আপনার কাছে কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্রটা আছে?”
রাষ্ট্রপতি তাকে বলেন, “আমি শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু আমার কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।”
মতিউর রহমান চৌধুরীর এই লেখা প্রকাশের আগে থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবি জানিয়ে আসছেন।
আর এই লেখা প্রকাশের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদেরকে বলেন, “৫ অগাস্ট রাত ১১টার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন এবং তিনি ওটা গ্রহণ করেছেন এমন কথা বলে এবং একের পর এক কার্যাবলীর মধ্য দিয়ে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, উনি (রাষ্ট্রপতি) পুরো জাতিকে বার বার নিশ্চিত করেছেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। প্রায় আড়াই মাস পরে উনি যদি বলেন যে, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র দেননি, তাহলে এটা স্ববিরোধীতা, শপথ লংঘন। উনি এই পদে থাকার যোগ্যতা আছে কিনা সে সম্পর্কে প্রশ্ন আসে।”
উপদেষ্টা বলেন, “আপনার যদি শারীরিক বা মানসিক সক্ষমতা না থাকে বা আপনি যদি গুরুতর অসদাচারণ করেন, তখন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আর ওই পদে থাকতে পারেন কিনা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার স্কোপ আমাদের সংবিধানে আছে।”
এরপর মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তেব্যের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার একমত।
তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে আইন উপদেষ্টা এদিন সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে বৈঠকও করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শহীদ মিনারে সমাবেশ করে ‘এ সপ্তাহের মধ্যেই’ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ, সংবিধান বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে।
আর ‘রক্তিম জুলাই ২৪’, ‘স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি’, ‘বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা’ ‘ইনকিলাব মঞ্চ’সহ বিভিন্ন ব্যানারে আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন অংশ বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়।
বঙ্গভবনের বাইরে তাদের বিক্ষোভ চলে গভীর রাতেও। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা মাইকে ঘোষণা দিয়ে বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়। পরে বঙ্গভবনের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন সেনা সদস্যরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক রাতে বঙ্গভবনের সামনে গিয়ে দুই দিন সময় চেয়ে আন্দোলনকারীদের সরে যেতে অনুরোধ করলেও গণ অধিকার পরিষদের একাংশ অনড় থাকেন। তখুনি রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন তারা। এ পরিস্থিতিতে মধ্যরাত পর্যন্ত বঙ্গভবনের বাইরে নাটকীয়তা চলে।
রাষ্ট্রপতির অপসারণে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া কী কী
রাষ্ট্রপতির অভিশংসন বিষয়ে সংবিধানের ৫২। (১) অনুচ্ছেদে সংবিধান লংঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে অভিশংসনের যে প্রক্রিয়া বলা আছে, সেগুলো সুনির্দিষ্ট।
এ জন্য অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সই নিয়ে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে দিতে হবে।
স্পিকারের নোটিস দেওয়ার দিন থেকে ১৪ দিনের পূর্বে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হতে পারবে না। এ সময় সংসদ অধিবেশনে না থাকলে স্পিকার সংসদ আহ্বান করবেন।
৫২ (২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এর অধীন কোনো অভিযোগ তদন্তের জন্য আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাতে পারবে সংসদ।
৫২ (৩) অনুচ্ছেদ বলছে, অভিযোগ-বিবেচনাকালে রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকার এবং প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।
৫২ (৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অভিযোগ-বিবেচনার পর সংসদের সদস্য-সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাব পাস হলে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
অসামর্থ্যের কারণে অপসারণ
৫৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে পদ থেকে অপসারণ করা যাবে। সে ক্ষেত্রেও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সইসহ স্পিকারকে প্রস্তাব দিতে হবে।
সংসদ অধিবেশনে না থাকলে স্পিকার অধিবেশন আহ্বান করবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব করিবন। প্রস্তাব গৃহীত হলে স্পিকার তৎক্ষণাৎ সেই নোটিশের প্রতিলিপি রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন। তাতে অনুরোধ করার তারিখ থেকে ১০ দিনের মধ্যে তাকে পর্ষদের কাছে পরীক্ষার জন্য উপস্থিত হতে বলা হবে।
রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে স্পিকারের কাছে প্রস্তাবের নোটিশ দেওয়ার ১৪ দিনের আগে বা ৩০ দিনের পর সেটি ভোটে দেওয়া যাবে না। অনুরূপ মেয়াদের মধ্যে প্রস্তাবটি উত্থাপনের জন্য আবার সংসদ আহ্বানের প্রয়োজন হলে স্পিকার সেটিই করবেন।
প্রস্তাবটি বিবেচিত হওয়ার সময় রাষ্ট্রপতির উপস্থিত থাকার এবং প্রতিনিধি পাঠানোর অধিকার থাকবে।
প্রস্তাবটি সংসদে উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য চিকিৎসা পর্ষদের কাছে উপস্থিত না হলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাবে। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে পাস হলে সেদিনেই রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।
অপসারণের জন্য প্রস্তাবটি সংসদে উস্থাপিত হওয়ার আগে রাষ্ট্রপতি পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য পর্ষদের কাছে উপস্থিত হলে সেই পর্ষদ যতক্ষণ না সংসদের কাছে মতামত পেশ না করবে, ততক্ষণ রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে ভোট হবে না।
সংসদে পর্ষদের রিপোর্ট বিবেচিত হওয়ার পর সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রস্তাবটি গৃহীত হলে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হইবে।