নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজারের ঐতিহাসিক শাহী মসজিদ ঘিরে রহস্যের যেন শেষ নেই। ব্রিটিশ আমলে জড়িয়ে থাকা অত্যাচারী জমিদারদের ধর্মীয় গোড়ামি, নানান বিরোধে মাটি চাপা দেয়া হয় মসজিদটিকে। পরে উদ্ধারের পর তৎকালীন দিল্লির আদালতের দেয়া রায়ে এতে নামাজ পড়ার সুযোগ পান স্থানীয় মুসলিমরা। ঐ দ্বন্দ্বে আজও লোমহর্ষকর স্মৃতিতে মৌলভী শমসেরের হত্যাকাণ্ড।
কারুকার্য ও নির্মাণশৈলীর বিবেচনায় মোগল স্থাপত্যের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের মুড়াপাড়ার শাহি মসজিদ। প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদ।
বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহি মসজিদ। বর্গাকার মসজিদটির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ ৪০ ফুট করে। চারপাশের দেয়াল ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি চওড়া। পূর্বপাশে রয়েছে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। এর ইটের দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি, প্রস্থ ১০ ইঞ্চি এবং চওড়া ২ ইঞ্চি। কালের আবর্তে মসজিদটির দেয়াল, ছাঁদে ও গম্বুজে ফাটল আর সামনের জমি বেদখলের ঘটনায় হুমকীর মুখে পড়েছে মসজিদটি।
শাহি মসজিদের পাশে রয়েছে ৫টি কবর। এখানে শায়িত এ মসজিদের জমিদাতা পরগনার মালিক আছিয়া খাতুনও। আরেকজন মৌলভী শমসের মিয়া। মসজিদের বর্তমান মুয়াজ্জিন মৌলভী ইব্রাহিমের দেয়া তথ্যে জানা যায়, মুড়াপাড়া জমিদার বাড়ির জমিদারদের লোকজন এক সময় স্থানীয় মুসলমানদের বিতাড়িত করতে নানা অত্যাচার করতন। এক সময় মুড়াপাড়া বাজারের এ শাহী মসজিদটি তৎকালীন ১ গম্বুজ বিশিষ্ট অংশ হাতি দিয়ে মাটি রেখে পুরো মসজিদ মাটি চাপা দিয়ে রাখে। এরপর মাঝখানে প্রায় ৮০ বছর এ মসজিদ স্থানীয়রা ব্যবহার করতে পারেননি।
তবে ২শ বছর আগে স্থানীয় মুসুল্লিরা মিলিত হয়ে মাটি চাপা সরিয়ে মসজিদ উন্মুক্ত করেন। এরপর নাওড়া গ্রামের মৌলভী সমশেরসহ স্থানীয় মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আজান দিলে জমিদারের লোকজন হাতি নিয়ে হামলা চালায়। এ সময় গ্রামের মুসলমান আর হিন্দু জমিদারের লোকজনের সাথে সংঘর্ষকালে মৌলভী শমসের মিয়াকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
পরে এ ঘটনায় প্রথমে কলকাতার আদালত পরে দিল্লির কেন্দ্রীয় আদালতে মামলা হলে ওই মামলার রায়ে শাহী মসজিদটি পুনরায় মুসলমানরা স্বাধীনভাবে নামাজ আদায় করেন। তবে আছিয়া খাতুনের স্মৃতি কিংবা মুসলিম বীর মৌলভী শমসের মিয়ার স্মৃতি রক্ষা চান এলাকাবাসী। যদিও মসজিদের জমির বিরোধ কাটেনি এখনো।
বর্তমানে মসজিদে রয়েছে খাঁজকাটা ৩টি গম্বুজ। ছাদে রয়েছে মোটা ৬ টি এবং চিকন ৬ টি মিনার। তবে মূল মসজিদটির সামনের অংশে মুসুল্লিদের জায়গা বাড়ানোর জন্য করা হয়েছে অস্থায়ী বারান্দা সাদৃশ্য টিনের চালা। যাতে অনেকটাই ঢেকে গেছে মসজিদের সৌন্দর্য। এমনি প্রধান ফটক অক্ষত থাকলেও তা ব্যবহার হচ্ছে না। মাটি চাপা থেকে উদ্ধার করায় স্থানীয়দের কাছে এ মসজিদ গায়েবী মসজিদ হিসেবেও পরিচিত। তবে তাদের দাবী, মসজিদটি রক্ষায় সরকারী, বেসরকারি উদ্যোগ।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৪৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের ইলিয়াস শাহি বংশের উত্তরাধিকার নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের ছেলে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ তৎকালীন আছিয়া খাতুনের পরগনা শীতলক্ষ্যা তীরের মুড়াপাড়া এলাকায় আসেন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন জৌনপুরের শাসনকর্তা মাহমুদ শর্কী, মুসলমান সাহিত্যিক আমীর জয়েনউদ্দীন, আমীর শিহাবউদ্দীন কিরমানী, মনসুর সিরাজী ও দেহরক্ষী বাসুদেব বসু। মোগল রীতি অনুযায়ী বরবক শাহ আছিয়া খাতুনের পরগনায় মসজিদ নির্মাণ করেন।
নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর বরবক শাহের নামানুসারে মসজিদটির নামকরণ করা হয় শাহি মসজিদ। আছিয়া খাতুন তার পরগনা থেকে ১৮ বিঘা জমি এ মসজিদের নামে দিয়ে দেন। তাই আছিয়া খাতুনের মসজিদ নামেও জানেন স্থানীয়রা।