21 C
Dhaka
শনিবার, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪

সনাতনি কোম্পানিগুলোর লক্ষ্যই ছিল শুধু মুনাফা অর্জন

দেশে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক পণ্য উৎপাদিত হলেও এসবের মানোন্নয়নে কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এতে ভোক্তাস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হলেও সেদিকে কোন তোয়াক্কা ছিল না সনাতনি কোম্পানিগুলোর। বরং ক্রেতাদের পকেটের টাকা হাতিয়ে মুনাফা অর্জনই ছিল এসব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। রহস্যজনক কারণে এসব বিষয়ে নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও তেমন কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। এই সুবাদে বিপুল অংকের টাকা চলে গেছে বিদেশে।

তবে দেরিতে হলেও আন্তর্জাতিক পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠান। সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে এসব প্রতিষ্ঠানের পণ্যগুলো স্থানীয় বাজারে আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। নিজস্ব কারখানায় মানসম্মত পণ্য বাজারজাতকরণে এরই মধ্যে তারা সাড়াও ফেলেছে বেশ। তাদের মধ্যে অন্যতম শীর্ষ কোম্পানি রিমার্ক এলএলসি ইউএসএ-এর এফিলিয়েটেড ব্র্যান্ডগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মিশেলে সর্বোৎকৃষ্ট পণ্য উৎপাদনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। যদিও তাদের নানা চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে এগুতে হচ্ছে।

তারা বলেন, সনাতনি কোম্পানিগুলো পণ্যের চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন তৈরি, সম্প্রচার এবং মার্কেটিং খাতে বিনিয়োগ করে বাজার সম্প্রসারণে যতটা উদ্যোগী, পণ্যের মান বাড়াতে ঠিক ততটা পিছিয়ে। তবে আশার আলো দেখাচ্ছে, কয়েকটি নতুন কোম্পানি, যারা এরই মধ্যে দেশে আন্তর্জাতিক মানের প্যাকেজিং সম্বলিত পণ্য উৎপাদনে এগিয়ে এসছে।

বৃহস্পতিবার (৩ অক্টোবর ২০২৪) রাজধানীর কারওয়ানবাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও এসোসিয়েশন অব স্কিনকেয়ার এন্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অব বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ ট্যাগযুক্ত পণ্যের মান বিষয়ক সেমিনারে এসব কথা বলেন বিশেষজ্ঞ আলোচক এবং খাত সংশ্লিষ্টরা।

তথ্য বলছে, ভোক্তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের ফাস্ট মুভিং কনজিউমার গুডস ইন্ট্রাস্ট্রি (এফএমসিজিআই) সেক্টরের আকার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে, যা একে দ্রুত বর্ধনশীল শিল্পগুলোর মধ্যেও একটি করে তুলেছে। বর্তমানে এ বাজারের আকার প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার হলেও ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজার হয়ে উঠবে। রাজস্ব খাতে এটি প্রত্যাশিত, ২০২৭ সালের মধ্যে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হবে ১৬ শতাংশেরও বেশি।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তথাকথিত ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির মতো করে কোন কোন কোম্পানি বাংলাদেশের বাজার থেকে শুধু মুনাফাই লুটেছে। কিন্তু ক্রেতাস্বার্থ বিবেচনায় নেয়নি। ফলে দেশের মানুষ বিদেশে থেকে কসমেটিকস ও খাত সংশ্লিষ্ট পণ্যগুলো নিয়ে আসেন। কারণ তারা মনে করেন, বিদেশী পণ্য এ দেশে উৎপাদিত পণ্যের চাইতে উন্নত।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাজী মুহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, বাজার নিম্নমানের কসমেটিকস পণ্যে সয়লাব হলে তা মানুষের জীবনে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হবে। ভুয়া পণ্য ব্যবহার করে অনেকে এরই মধ্যে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসার জন্য পরিবারেও দিন দিন আর্থিক সঙ্কট বাড়ছে। এজন্য দেশে বিশ্বমানের কসমেটিকস ও হোমকেয়ার পণ্য উৎপাদনের বিকল্প নেই। এতে দেশের মানুষের কর্মসংস্থানও বাড়বে। রিমার্ক-হারল্যানসহ যে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে গুণগত মান বজায় রেখে অথেনটিক পণ্য দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ভোক্তা অধিদপ্তরও তাদের পাশে থাকবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী তথ্য দেন, দেশে প্রসাধনী এবং ব্যক্তিগত যত্নের সামগ্রীর বার্ষিক বাজার এখন প্রায় ৯০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আশা করা হচ্ছে যে ২০২৭ এ ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে বাড়বে। তবে বাংলাদেশের প্রসাধনী খাত ব্যাপকভাবে আমদানির উপর নির্ভর করে। প্রসাধনী রাসায়নিকের ৯০ শতাংশই আমদানি নির্ভর। বিশেষত, মোট আমদানিকৃত কসমেটিক পণ্যের প্রায় ৪১% ভারত থেকে আসে। এ অবস্থার পরিবর্তনে মানসম্মত দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাতের কোন বিকল্প নেই।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিআই’র পরিচালক ইসহাকুল হোসেন সুইট বলেন, স্কিন কেয়ার, কসমেটিকস ও হোম কেয়ার খাতে রিমার্ক-হারল্যানের মতো দেশীয় কোম্পানি এগিয়ে আসায় তারা বিশেষভাবে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তাদের মতো প্রতিষ্ঠান মানসম্মত অথেনটিক পণ্য উৎপাদন করায় ক্রেতাদের মাঝে দেশীয় পণ্য ব্যবহারে আগ্রহও বাড়ছে।

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ- আইবিএফবি-এর সহসভাপতি এম এস সিদ্দিকী মনে করেন, দেশীয় শিল্পের প্রসারে সরকারকে দিতে হবে সব ধরনের সহায়তা। কারণ আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে দেশের কোম্পানিগুলোকে এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। যেসব প্রতিষ্ঠান দেশে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য উৎপাদন করছে, তারা যেন বিশেষ নীতিসহায়তা পান, তাও নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে দেশীয় শিল্পের প্রসারে আগ্রহী হয়ে অনেকে এগিয়ে আসবেন।

বিএসটিআই এর উপপরিচালক মোরশেদা বেগম তার বক্তব্যে বলেন, আমরা চেষ্টা করছি পণ্যের মান যেন নিশ্চিত হওয়ার পর বাজারজাত হয়। তাছাড়া নতুন পণ্যের বাজারজাত করনের আগে পণ্য, মোড়কসহ সকল বিষয়ের মান নিয়ে কাজ করছি। আমরা রপ্তানি যোগ্য পণ্যের মান নিশ্চিতকরণে জোর দিচ্ছি। সামগ্রিক উৎপাদনের ৩০% পণ্য বিএসটিআই মান সনদের আওতায় আনতে পেরেছে।

চিত্রনায়ক মামনুন হাসান ইমন জানান, দীর্ঘ দিন ধরে দেশে মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত না হওয়ায় বিদেশি পণ্যের প্রতি মানুষের দুর্বলতা ছিল। এছাড়া বড় কোম্পানিগুলো দক্ষ মার্কেটিং ও সেলস পার্সনদের নিয়োগে বেশি গুরুত্ব দিলেও পণ্যের মানোন্নয়নে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। চটকদার বিজ্ঞাপন তৈরি, প্রচার ও পণ্য বিক্রিতেই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে। গবেষণা ও কারখানা ব্যবস্থাপনাসহ মৌলিক জায়গাগুলোয় তেমন কোন বিনিয়োগ হয়নি। এটি প্রকারান্তরে ক্রেতাদের সাথে প্রতারণা শামিল। খুশির কথা যে, দেশে এখন মানসম্মত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তার প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহও বাড়ছে। সুতরাং দেশে উৎপাদিত গুণগত মানের পণ্যের প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস যেন বাড়ে সে উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। দেশে উৎপাদিত মানসম্মত ও অথেনটিক পণ্য ব্যবহারে মানুষের মাঝে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। মানুষ এখন দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে চায়। এক্ষেত্রে রিমার্ক-হারল্যানসহ দেশিয় কিছু কোম্পানি এগিয়ে আসায় তাদের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান তিনি।

এ খাতের বাণিজ্য সংগঠন এসোসিয়েশন অব স্কিন কেয়ার এন্ড বিউটি প্রোডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স বাংলাদেশ এর সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ কনজিউমার গুডস খাতে বড় বাজার হলেও পণ্য বিক্রেতাদের আন্তর্জাতিক মানের বিষয়টি আমলে নিতে দেখা যায়নি। মানহীন ও ভেজাল পণ্য কিনে ক্রেতারা প্রতারিত হতেন। দীর্ঘদিন পর হলেও ভোক্তা অধিকার ভেজাল রোধে কাজ করছে। ফলে মানুষের মাঝে সচেতনতা বেড়েছে। চাহিদা তৈরি হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযিুক্তির পণ্যের। বেশ কিছু কোম্পানি এখন উন্নত ফর্মুলেশন-গবেষণা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগে এগিয়ে এসছে।

স্কিন কেয়ার বিশেষজ্ঞ ডা. শারমিনা হক মনে করেন, নকল ও ভেজাল পণ্য ব্যবহার করে মানুষ স্কিন ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এ থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মানসম্পন্ন পণ্য ব্যবহার করা। রিমার্ক ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে, মানুষের জীবনমান উন্নয়নে যেসব পণ্য বাজারে আনছে, আশা করি দেশের মানুষ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির এসব পণ্য ব্যবহার করে উপকৃত হবেন।

ড. সাকুন মাংগুত তার উপস্থাপনায় বলেন, আসলে বাংলাদেশের উচিত এখন পণ্য নয় প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে বেশি নজর দেয়া। বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যের আস্থা অর্জনে গবেষণায় জোর দেয়ার জন্য তাগিদ দেন। তিনি দেশী ব্র্যান্ডগুলোকে ডেভলপ করা এবং তার ধারাবাহিকতায় গুরুত্ব দেন। একই সঙ্গে ভোক্তার আস্থা অর্জনের জন্য দীর্ঘ মেয়াদী গবেষণা, পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের পরামর্শ দেন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

বিশেষ প্রতিবেদন