হাইপারলিংক সিনেমার ধারণাটা শুরু করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তার কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমায়। তখন সেরকম নাম দেয়া হয় নাই। হাইপারলিংক বলে এখন যে বিষয়টি আমাদের চেনা, তখন সেটা ছিল না। তখন এধরণের সিনেমার বুননকে বলা হতো নন-লিনিয়ার স্টোরিটেলিং। একই ছাতার নিচে আশ্রয় নিতো অন্যান্য অনেক রকম পরীক্ষামূলক গল্প বলার পদ্ধতিও।
হাইপারলিংক সিনেমা একটু পৃথক, বিশেষায়ীত। এতে একসঙ্গে কয়েকটি ঘটনা এগিয়ে যায়, কারো সাথে কারো কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু শেষটি এসে মেলে এক বিন্দুতে। হয় তো একটা মাছের গল্প আর একটা গাছের গল্প আলদা চলছে। শেষে দেখা যায় মাছটা গাছে চড়ছে। গল্প বলার এই স্টাইলটাকে আরেক ভাবেও দেখা যেতে পারে। ধরেন কয়েকটা শর্ট ফিল্ম একই সুতায় গেঁথে ফেললেও একটা হাইপারলিংক সিনেমা হয়ে যাবে।
আলেহান্দ্রো গনজালেস ইনারিতু শুরু করেছিলেন শর্ট ফিল্ম দিয়ে, তার তিনিটি হাইপারলিংক সিনেমাও আছে। যদিও তাকে সবাই চেনে অস্কারের ডালি সজানো বার্ডম্যান আর দ্য রেভেনেন্ট দিয়ে। তবু ইনারিতুর ‘ডেথ ট্রিলজি’ হাইপারলিংক সিনেমার চরম উৎকর্ষ।
অ্যামোরেস পেররোস, মেক্সিকোর ছবি, ভাষা স্প্যানিশ। ডেথ ট্রিলজির প্রথম ছবি। এর পরের ছবিটি তিনি হলিউডে গিয়ে করেন, টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামস। আর ট্রিলজির শেষ ছবি বাবেল। তিনটা সিনেমার উপাদান প্রায় একই – দুর্ঘটনার মাঝে পরে যাওয়া জীবন, বাস্তবতা, বিষণ্নতা এবং মৃত্যু। সিনেমা তিনটির চিত্রনাট্য গিয়ের্মো আরিগার।
তবে ২১ গ্রাম ছাড়া কোন সিনেমার আঁশ মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হয়নি। সত্যি, যে অন্য দুটি সিনেমাতেও মৃত্যুর ঘটনা আছে। তবে লর্ড অভ দা রিংস সিরিজের তিনটা সিনেমায় বামনেরা আছে বলে এদের বামন ট্রিলজি বলার তো মানে হয় না। ডেথ ট্রিলজি তাই একটা নাম মাত্র। একে মূল সুর ভাবার দরকার নেই বলেই মনে হয়।
আকিরা কুরুসাওয়ার রশোমনে আমরা দেখি একটি ঘটনার নানা রকম প্রেক্ষিত। বিভিন্ন জন একই ঘটনার নালাদা আলাদা বয়ান দেয়। তাতে একটি ঘটনাই অনেকগুলো ঘটনা হয়ে উঠে। ইনারিতু উলটো কাজটা করেন তার সিনেমায়, বিভিন্ন ঘটনা একটি ঘটনায় এসে মেলে। এই মিলনবিন্দুটিই সবগুলো ঘটনার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।
অ্যাামোরেস পেররোস দিয়ে শুরু করি। এর মূল থিম ‘লাইফ ইজ আ বিচ’। ননলিনিয়ার হাইপারলিংক সিমেনার আদর্শ উদাহরণ। এটি যেন মেক্সিকান পাল্প ফিকশন। এ্যারিগা দুই বছর ধরে চিত্রনাট্য লিখেছেন। শ্যুট হয়েছে ৫৫ দিনে। আবার হ্যান্ডহেল্ড ক্যামেরায়। ট্রাইপড, ট্রলি, ডলি, ক্রেনের বিলাসিতা করার উপায় ছিল না। সিনেমা বানাতে টাকা লাগে অনেক। তার পরেও এমন মহাকাব্য বানানোর জন্যে ইনারিতুর ডিওপি, সিনেমাটোগ্রাফার আর ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টকে শিরোপা দিতেই হবে।
তিনটি ঘটনা মিলিয়ে এই ছবি। শুরুটা ভয়ংকর এক গাড়ি দুর্ঘটনা দিয়ে। মূলত এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করেই পুরো ছবি। প্রথম ঘটনা অক্টাভিয়া ও সুজানাকে নিয়ে। সুজানা অক্টাভিয়ার ভাইয়ের স্ত্রী। অক্টাভিয়া সুজানাকে নিয়ে পালিয়ে যেতে চান, এর জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থের। অক্টাভিয়া জড়িয়ে পড়েন কুকুরের লড়াইয়ে। তার পোষা কুকুরটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এই লড়াইয়ে। এ নিয়ে দ্বন্দ্বে একজনের শরীরে ছুরি চালিয়ে পালান অক্টাভিয়া, পথে ঘটে দুর্ঘটনা।
পরের কাহিনি ড্যানিয়েল আর ভেলেরিয়ার। বিবাহিত ড্যানিয়েল একজন সফল ম্যাগাজিন প্রকাশক আর ভেলেরিয়া সফল মডেল। ড্যানিয়েল আগের সংসার ছেড়ে চলে আসেন ভেলেরিয়ার কাছে। ওই দিনই ভেলেরিয়া বাইরে গেলে পথে ঘটে দুর্ঘটনাটি। পঙ্গু হন ভেলেরিয়া। তৃতীয় ঘটনা সাবেক গেরিলা আর একসময়কার ভাড়াটে খুনি এল চিবোর। সেও জড়িয়ে পড়ে এই দুর্ঘটনার সঙ্গে।
টুয়েন্টি ওয়ান গ্রামস হচ্ছে সেই ওজনের পার্থক্য যেইটা সদ্যমৃত মানুষের সাথে তার জীবিত অবস্থার পার্থক্য! মানুষের মৃত্যু হলে নাকি ওজন ২১ গ্রাম কমে যায়। জীবনের ওজন কি তবে ২১ গ্রাম? এই সিনেমার নাম তবে জীবন। ২১ গ্রাম ওজনের জীবন। এবং মৃত্যু। ছবিটির কাহিনীর মূল যোগসূত্রও দুর্ঘটনা ঘিরে।
দেল তোরো জেল খেটে বের হওয়া মানুষ, যিনি ধর্মে আস্থা রাখতে শুরু করেছেন। মৃত্যুর পথে থাকা শন পেন অঙ্কের শিক্ষক, যাঁর হার্ট বদল না হলে বাঁচার আশা নেই। স্বামী আর দুই মেয়ে নিয়ে নোয়ামি ওয়াটসের সংসার। ডেল তোরোর গাড়ির ধাক্কায় মারা যায় নোয়ামির দুই মেয়ে, স্বামীর মৃত্যুর আগে হার্ট দিয়ে দেন শন পেনকে। এভাবেই এক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে যায় তিনজন। বাড়তে থাকে সম্পর্কের জটিলতা। টোয়েন্টি ওয়ান গ্রামসের পুরস্কারভাগ্যও খুব খারাপ নয়।
বাবেল ইনারিতুর ডেথ ট্রিলজির শেষ ছবি। বাইবেলের মিথ, টাওয়ার অভ বাবেলের নাম থেকে ইনারিতু এই নামটা নিয়েছেন। বাবেলের অর্থই হলো ভেদ বা ডিফরেন্স। পৃথিবীর মানুষের ভাষা ছিল একটা, একসাথেই থাকতো। ঐক্যবদ্ধ মানুষ অনেক শক্তিশালি, তারা ইশ্বরকেও চ্যালেঞ্জ করতে পারে। স্বর্গে যাবার জন্যে তারা একটা পরিকল্পনা করল। তারা ভাবলো এমন একটা উঁচু মিনার বানানো যাক, যেটা আকাশ ফুঁড়ে স্বর্গে চলে যাবে। সদাপ্রভু ভাবলেন, আচ্ছা বিপদ!স্বর্গের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে তিনি মানুষের ভাষার পৃথক করে দিলেন। ফলে মানুষ আর একে অপরের ভাষা বুঝতে পারলো না আর । তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
বাবেলের গল্প চারটা। এই চারটা গল্প ডালপালা মেলেছে তিনটি মহাদেশে, ৫টি আলাদা ভাষায়। শেষে সব মিলেছে একই বিন্দুতে। হাইপারলিংক আর কাকে বলে! বাবেল মানুষে মানুষে সম্পর্কের সিনেমা। যে সীমানা দেশ থেকে দেশ বিভক্ত করে, সংস্কৃতি আর ভাষাকে বিভক্ত করে সেই সিমানা মুছে ফেলার সিনেমা।
মরক্কোর দক্ষিণে মরুভূমি এলাকায় মেষপালক আবদুল্লাহ একটা শক্তিশালী রাইফেল কিনলেন হাসানের কাছ থেকে। শিয়াল তাড়ানোই মূল উদ্দেশ্য। আবদুল্লাহর দুই ছোট ছেলে ইউসুফ ও আহমেদ সেই রাইফেল দিয়ে মেষ পাহারা দেয়। আহমেদের সন্দেহ এই রাইফেলের গুলি তিন কিলোমিটার পর্যন্ত যাবে না। ইউসুফ গুলি করে দেখিয়ে দিল যে গুলি এর চেয়েও বেশি দূরে যায়। দূরের রাস্তায় তখন যাচ্ছিল পশ্চিমা পর্যটকদের নিয়ে একটি বাস। গুলি লাগল সানডিয়াগোর সুসানের গলার কাছে। সঙ্গে তাঁর স্বামী রিচার্ড।
মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সেই সংবাদ। মার্কিন প্রশাসন তাদের নাগরিকের ওপর এটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হিসেবে প্রচার করল। তৎপর হলো পুলিশ। শুরু হলো নতুন কূটনৈতিক জটিলতা। হাসানকে রাইফেলটি উপহার দিয়েছিলেন আরেক জাপানি পর্যটক ইয়াসুজিরো, হাসান ছিলেন তাঁর গাইড। ইয়াসুজিরোর একটি মেয়ে আছে, সে মূক ও বধির। ওই রাইফেল নিয়ে শুরু হলো আরেক জটিলতা।
ক্যামেরা আবার চলে যায় সান ডিয়াগোতে। সুসান ও রিচার্ডের যমজ সন্তান। মেক্সিকান এমেলিয়া তাঁদের হাউসকিপার। এমেলিয়ার ছেলের বিয়ে মেক্সিকোতে। যেতেই হবে, বাচ্চাদের রেখেও যেতে পারছেন না। মাথায় কী ঢুকল, ওদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন মেক্সিকোয়। ফিরতে গিয়ে পড়লেন ঝামেলায়। মরুভূমির মধ্যে এমেলিয়া হারিয়ে ফেললেন দুই বাচ্চাকে।
বাবেলের গল্প ইনারিতুকে ‘ডিরেকটর উইদাউট বর্ডার’ অভিধা দিয়েছে। ইনারিতু মনে করেন রাষ্ট্র-সরকার, ধর্ম, জাতিপরিচয় আর করপোরেটরা দেশে দেশে মিথ্যাকারের সীমানা তুলে দিয়েছে, পৃথিবীর কোন সীমানা নাই। সেই সীমাতের ধারণা মাননতার বিপরিত রাশি। এই সীমানার ধারণা মানুষকে বাইবেলের বেবেলের মতই বিচ্ছিন্ন, বিভাজিত, পরষ্পরেরপ্রতি কলহপ্রবণ করে তুলেছে।
ইনারিতু সিনেমায় নির্দেশনায় নামার আগে মিউজিক কম্পোজার ছিলেন। সেইসময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন – তিনি একজন “ফ্রাস্ট্রেটেড মিউজিশিয়ান”। তিনি নব্বইয়ের দশকে মেহিকোর তুমুল জনপ্রিয় ডিজে ছিলেন। মেইনস্ট্রিম চটুল মেহিকান মুভির সহকারী পরিচালনা করেছেন। পুরাই যাযাবর জীবন তার। আলেহান্দ্রো ইনারিতুর যাদুকরি সিনেমাগুলোর পিছনে আছে তার ইচ্ছামতন চলা দূর্দান্তরকমের বিচিত্র জীবন। অক্টাভিওর চরিত্রে ইয়ারিতুর নিজের ছায়া আছে। ইনারিতুর শুরুর দিকের কাজ আমাদের উত্তর আধুনিক খেই হারানো বিহ্বলদশার গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।